পুলিশ রাষ্ট্রের অপরিহার্য একটি অঙ্গ। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান তাদের দায়িত্বে। তাই প্রত্যাশা সঙ্গত যে তারা দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনকে মূলনীতি হিসেবে অনুসরণ করবে। এ ক্ষেত্রে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা সদস্য আবার বাঁকা পথে হাঁটেন! কিন্তু বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারীতে নিজের দক্ষতা ও কর্ম তৎপরতার মাধ্যমে জনগণের মন জয় করেতে পেরেছেন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আবু মুসা।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সৎ-সাহসীকতা এবং নিষ্ঠাবান পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আবু মুসা বাইশারীতে সহজাত পরিচিত। তিনি বাইশারী পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের প্রধান। অপরাধের শত্রু আর অপরাধীদের কাছে আতঙ্কের নাম। পেশার তাগিদে কারও সাথে কখনো আপোষ করেননি। অথচ বাইশারীতে তাঁর আগমনটা ছিলো কঠিন এক মুহুর্তে। গেল বছরের ১৪মে চাকপাড়ায় বৌদ্ধ ভিক্ষু উ গাইন্দ্যার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলায় ও ঘাড়ে কুপিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার রেশ কাটাতে না কাটতেই পুলিশ ৩০জুন রাতে বাইশারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা মংশৈলুং মারমার মরদেহ উদ্ধার করে। বৌদ্ধ ভিক্ষুর আদলে একই কায়দায় ওই আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
ভিক্ষু হত্যার ২২ দিন পর ৫জুন এবং অওয়ামী লীগ নেতা হত্যার পর দিন ১জুলাই জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) তাদের নিউজ ফিড আমাক নিউজ-এ দুটি হত্যার দায় স্বীকার করলে অতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। এর আগেও বাইশারীতে বোমা বিস্ফোরণসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিলো। বাইশারীতে অপহরণ এবং ডাকাতির ঘটনা ছিলো নৈত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অনেকটা আতঙ্কের জনপদে ২০১৬ সনের আগষ্ট মাসের প্রথম তারিখে বাইশারী পুলিশ তদন্তকেন্দ্র প্রধান হিসাবে যোগদান করেন উপপরিদর্শক আবু মুসা।
আগের দিনের বাংলা ছবিতে প্রায়ই দেখা যেতো, ‘অপরাধে ঘেরা একটি জনপদে আসেন সৎ একজন পুলিশ কর্মকর্তা। যিনি পুরো এলাকাকে সৎ রাখতে চান, মানুষকে নিরাপত্তা দিতে চান, জনগণের সাথে বন্ধুর মতো বিনয়ি ন¤্র ব্যবহার করেন। ঠিক তেমনি দৃষ্টান্ত রেখেছেন পুলিশ কর্মকর্তা আবু মুসা। শুরু থেকেই উনি আধুনিকতা এবং দক্ষতার সাথে তাঁর মেধার বিকাশ ঘটিয়ে অপরাধ কমাতে থাকেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাইশারীতে উপপরিদর্শক আবু মুসা যোগদানের পর মাদকের ভয়াবহতা, বাল্য বিবাহ, খুন-খারাপি, অপহরণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ চাঁদাবাজির ঘটনা তেমন নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বস্তিবোধ করছেন এলাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ ব্যবসায়ী নেতারা। সাধারণ মানুষ বলছেন হঠাৎ করেই পাল্টে গেছে অপরাধ প্রবণ বাইশারীর দৃশ্যপট। গা ঢাকা দিয়েছে বাইশারী-ঈদগড়ের বনমন্ত্রী খ্যাত শীর্ষ সন্ত্রাসী আনোয়ার প্রকাশ আনায়া, ডাকাত আমির হামজা প্রকাশ আমজা, সবুর, হাকিম ও রশিদ’সহ অনেক অপরাধী। এছাড়াও বাইশারীতে যোগদানের পর পরই ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক আনিছুর রহমানের সহযোগিতায় মতলব ডাকাতকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে জনজীবনে স্বস্থি ফিরেয়ে আনেন আবু মুসা। জসিম ডাকাতসহ একাধিক ডাকাত ও অপরাধীকে আটক করে তিনি আদালতে সোপর্দ করেছেন।
বিভিন্ন সময় অপহৃত ব্যক্তিদের উদ্ধার অভিযানে গিয়ে গহীন অরণ্যে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গুলি বিনিময় করে সাহসিকতার পরিচয় দেন। সর্বশেষ চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি রামুর ক্রাইমজোন খ্যাত ঈদগড় ইউনিয়নের বৈদ্যপাড়ার পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে বিনামুক্তিপণে বাইশারীর অপহৃত আবুল বশরকে উদ্ধারের পাশাপাশি বাঁকখালীর শেষ প্রান্ত, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ির গহীন সীমান্ত অরণ্যে অভিযান চালিয়ে-সন্ত্রাসীদের আস্তানা ধ্বংস করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন আবু মুসা।
কারণ ওই এলাকায় এই পর্যন্ত সরকারী বাহিনীর কোন সদস্য যায়নি। তাঁর এসব তৎপরতার কারণে অপরাধীদের কেউ কেউ পেশা পাল্টে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে শুরু করেছে। আবু মুসার কৌশলী ভূমিকার কারণেই ভেঙ্গে পড়েছে অপরাধীচক্রের নেটওয়ার্ক।
বাইশারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই উন্নতিতে স্বস্থিতে আছেন এলাকাবাসী। আবু মুসা যোগদানের পর ইউনিয়নের নয়টি বৌদ্ধ বিহার এবং একটি মন্দিরে স্থানীয়দের নিয়ে কমিটি গঠন করে পাড়া মহল্লায় প্রতিরাতে পুলিশী নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছেন। তিনি জনপ্রতিনিধি ও জনগণের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বাইশারীতে অপরাধ শূণ্যের কোঠায় নিয়ে এসেছেন।’
ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মনিরুল হক মনু বলেন, ‘এসআই আবু মুসার কর্মদক্ষতার ছোঁয়া সমৃদ্ধ করেছে বাইশারীবাসীকে। এ ধরণের কর্মকর্তারা অপরাধীদের আতঙ্ক।’
বাইশারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বাহাদুর বলেন, ‘এসআই আবু মুসার কৌশলী ভূমিকার কাছে হার মেনেছে অপরাধীরা। পাড়া-মহল্লায় শান্তি-শৃঙ্খলা কমিটি তৈরি করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করেছেন। বড় ধরণের বিরোধ নিষ্পতি করে শান্তির আবহ এনেছেন। তিনি প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখেন।’
ঈদগড় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম বলেন, ‘বাইশারীতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় বাইশারী-ঈদগড়-ঈদগাঁও সড়কেও ডাকাতি হ্রাস পেয়েছে।’
নাইক্ষ্যংছড়ি প্রেসক্লাবের উপদেষ্টা তসলিম ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘ব্যবসা এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে জেলার মধ্যে নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি ইউনিয়ন। এখানে রাবারসহ নানা পন্য পাইকারী ও খুচরা বেচাকেনা হয়। যেকারণে চাঁদাবাজদের আনাগুনা ছিল। কিন্তু পাল্টে গেছে পরিস্থিতি। এখন পুলিশের অভিযানের মুখে কেউ চাঁদা নিতে আসে না। সন্ত্রাসীরাও চুরি ডাকাতি ছিনতাইসহ নানাবিধ অপকর্ম চালাতে পারছে না। তাঁরমতে এসআই আবু মুসা যোগদানের পর বাইশারীর চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা গাঁ ঢাকা দিয়েছে।’
জানতে চাইলে আবু মুসা বলেন, ‘গত আট মাসে বাইশারীতে খুন, ডাকাতি এবং চুরির মতো কোন ঘটনা ঘটেনি। একটি মাত্র অপহরণের ঘটনা ঘটেছিলো। তাও আবার ভিকটিমকে বিনামুক্তিপণে উদ্ধার করেছি। ওই অপহরণ মামলাসহ থানায় সর্বমোট তিনটি মামলা হয়েছে। যার মধ্যে দুটি মামলা স্থানীয় জমি-জমার বিরোধ নিয়ে। কোন ধরণের সাধারণ ডায়রি নেই। দিনে এবং রাতে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকায় সন্ত্রাসীরা এলাকাছাড়া।’
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ.এইচ.এম তৌহিদ কবির বলেন, ‘বাইশারীতে উপপরিদর্শক আবু মুসা সফলতার প্রমান রেখে চলেছেন। বর্তমান সরকার প্রধানের সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হয়েছে। লাখ লাখ মানুষের বেকারত্ব দূর করেছে। এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। তাই যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা রোধে পুলিশ সদা সজাগ রয়েছে। উপজেলার চলমান শান্ত পরিবেশ আগামীতেও অব্যাহত রাখতে পুলিশ নিরলসভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর কৃতি সন্তান আবু মুসা ২০১৩ সনে বাংলাদেশ পুলিশ বাহীনিতে উপপরিদর্শক (এসআই) পদে যোগদান করেন। এর পর থেকে তিনি বান্দরবান জেলায় কর্মরত আছেন। ইতোপূর্বে ২০১৬ সালের ২২ মার্চ অনষ্ঠিত মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউপি নির্বাচনে গুলি চালিয়ে তাজিয়াকাটা ভোট কেন্দ্র রক্ষা করেছিলেন। এর পর তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে ২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী ইউপি নির্বাচনের নারিচবুনিয়া ভোট কেন্দ্র রক্ষা করে পুলিশের ওপর মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
প্রসঙ্গত, বাইশারীতে যোগদানের পূর্বে আবু মুসা কর্মরত ছিলেন নাইক্ষ্যংছড়ি থানায়। এসময় ধুংরি হেডম্যানপাড়ার চাঞ্চল্যকর অপহরণ মামলার ভিকটিম চিং খেইমা মার্মাকে একই বছরের ১৮জুন উদ্ধার করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন। পাশাপাশি থানার চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা হিসাবে উপজেলার সর্বমহলে তিনি ছিলেন আলোচিত। তাঁর নানা কর্মকান্ডে অনেকটা মুগ্ধ হয়ে সেই সময় নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা পরিষদের (ভারপ্রাপ্ত) চেয়ারম্যান মো.কামাল উদ্দিন, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহবায়ক তসলিম ইকবাল চৌধুরীসহ অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ভূয়সী প্রশাংসা করেন।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।