কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির বয়স এখন ১২২ বছর। ১৯০১ সালে কক্সবাজার মহকুমা আইনজীবী সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৪ সালে কক্সবাজার মহকুমা জেলায় রূপান্তরিত হলে কক্সবাজার মহকুমা আইনজীবী সমিতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি হিসেবে রূপান্তরিত হয়। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৫/১/১৯৮৫ তারিখ। কক্সবাজারের প্রথম জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রব মোল্লা। কক্সবাজারের প্রথম পাবলিক প্রসিকিউটর আলহাজ্ব ফিরোজ আহমদ চৌধুরী ও প্রথম জিপি আলহাজ্ব আবুল কালাম আজাদ। কক্সবাজারের দ্বিতীয় জেলা জজ এম,এম,রুহুল আমিন এবং দ্বিতীয় পাবলিক প্রসিকিউটর আমি এডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। কক্সবাজারের জেলা জজদের মধ্যে এম,এম,রুহুল আমিন সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি, মোঃ আনোয়ার উল হক আপিল বিভাগের বিচারপতি,মোঃ এমদাদুল হক ও ভবানী প্রসাদ সিংহ হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হন। যুগ্ন জেলা ও দায়রা জজ মোঃ শওকত আলী চৌধুরীও এখন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আমাদের সাবেক জজদের নিয়ে আমরা আইনজীবীরা গর্ব করি। কক্সবাজারে মোট ১৬জন জেলা জজ দায়িত্ব পালন করে চলে গেছেন। ১৭তম জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে নিযুক্ত মোহাম্মদ শাহীন উদ্দিনকেই কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির ৩৮ বছরের ইতিহাসে প্রথম কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে আইনজীবী সমিতি ভবনের হলঘরে জেলার সকল বিচারক ও হলভর্তি আইনজীবীদের উপস্থিতিতে ফুল দিয়ে বরণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বরণ করা হয়েছে গত ৩১/৮/২৩ তারিখ।
সমিতির সভাপতি এডভোকেট সিরাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মোহাম্মদ তারেকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত বরণ অনুষ্ঠানে নবাগত জেলা জজ ব্যতীত আরো তিন জন জেলা জজের পদমর্যাদার বিচারক উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন যথাক্রমে কক্সবাজারের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নং১, ট্রাইব্যুনাল নং২ ও ট্রাইব্যুনাল নং ৩ এর বিচারক মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দিন, মোহাম্মদ নুরে আলম ও মোহাম্মদ আবু হান্নান। বর্তমানে কর্মরত চারজন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত নং২,৩,৪ ও ৫নং মোহাম্মদ সাইফুল ইলাহী, মোঃ আবদুল কাদের, মোঃ মোশারফ হোসেন ও নিশাত সুলতানা, যুগ্ন জেলা ও দায়রা জজ প্রথম ও দ্বিতীয় আদালতের বিচারক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ও মোছাঃ রেশমা খাতুন,চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আবদুল্লাহ আল মামুন,সিনিয়র সহকারী জজ সুশান্ত প্রসাদ চাকমা,সিনিয়র সহকারী জজ মৈত্রী ভট্টাচার্য, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গা, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আখতার জাবেদ,সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আসাদ উদ্দিন মোঃ আসিফ, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ সাজ্জাতুন নেছা লিপি, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মোহাম্মদ এহসানুল ইসলাম,সিনিয়র সহকারী জজ ওমর ফারুক,সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ফাহমিদা সাত্তার প্রমূখ। অনুষ্ঠানের শুরুতে নবাগত জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ শাহীন উদ্দিন সহ উপস্থিত সকল বিচারকদের কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। তখন উপস্থিত প্রায় অর্ধ সহ¯্রাধিক আইনজীবী হাততালি দিয়ে স্বাগত জানান।
আইনজীবী সমিতির পক্ষে বক্তব্য রাখেন সাবেক সভাপতিদের মধ্যে আমি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, আবুল কালাম ছিদ্দিকী,শাহ জালাল চৌধুরী,জিপি মোহাম্মদ ইসহাক,নুরুল ইসলাম,মোঃ সৈয়দ আলম,সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্বাস উদ্দিন চৌং, মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, পিপি ফরিদুল আলম, শিবু লাল দে ও বাবুল মিয়া। কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির ইতিহাস সৃষ্টিকারী বরণ অনুষ্ঠানে নবাগত জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ শাহীন উদ্দিন বলেন, বর্তমানে কক্সবাজার বিচার বিভাগে এক দল দক্ষ,কর্মঠ,পরিশ্রমী ও মেধাবী বিচারক রয়েছেন। যা মন্ত্রণালয় থেকে আগেই আমাকে অবহিত করা হয়েছে। যাদের নিয়ে আমি খুবই আশাবাদী,তাদের নিয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কক্সবাজারে একটা মডেল ও পরিচ্ছন্ন বিচার বিভাগ উপহার দেওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। এই প্রচেষ্টায় আমি আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করি। বিচারপ্রার্থীদের যাতে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হয়,বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস যাতে আরো বাড়ে,সেজন্য পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠার সাথে নিরলসভাবে কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।
বিগত ২১ আগস্ট দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকার ’অসত্য সংবাদ ও স্বপ্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ’ শিরোনামে অতিথি কলামে লেখা হয়েছিল, আশার সংবাদ হলো বর্তমানে কক্সবাজারে কর্মরত প্রায় ২১জন বিচারকের সততা সম্পর্কে আইনজীবীদের তথা কক্সবাজার জেলাবাসীর কোন সন্দেহ নাই। নবনিযুক্ত জেলা জজ মোহাম্মদ শাহীন উদ্দিনের নেতৃত্বে কক্সবাজারে আবার আইনে শাসন চালু হবে, মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায়/আদেশ/নির্দেশ/সার্কুলারকে আমলে নেওয়া হবে, সম্মান করা হবে, ইনশাআল্লাহ।
বরণ অনুষ্ঠানে আইনজীবীদের পক্ষে একজন বক্তা বলেছেন,বিদায়ী জেলা জজকে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে একটি অবৈধ আদেশ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে তলব করে তার সম্পর্কে যা মন্তব্য করেছেন তা দেশের সংবাদপত্রে ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বহুল প্রচার হয়েছে। তার সাথে কক্সবাজারের নামও উল্লেখ হওয়ায় আমরা লজ্জিত। সেই তর্কিত আদেশের সাথে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের ভুমিকা কি ছিল? তাদের কাছ থেকে কেন ব্যাখ্যা চাওয়া হয় নাই? কয়েক জন জামানত নিয়ে জামিন দেওয়া ও ফৌজদারী মিচ মামলায় শুনানীর দিন না দিয়ে বস্তাভর্তি করে রাখা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করলে নবাগত জেলা জজ বলেছেন আপনারা আইনজীবীরা কি করেছেন,আপনারা তো চুপ থেকে সম্মতি দিয়েছেন। সত্য যে মাত্র কয়েকজন আইনজীবীর ঘৃণ্য সিন্ডিকেট প্রকাশ্যে অপকর্মের সহযোগিতা করেছেন,অবৈধ সুযোগ নিয়েছেন। কিন্তু তার অপকর্ম আরো বাড়িয়ে দিলে বিগত ২৬/১১/২০২২ তারিখের কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সভায় তার বিরুদ্ধে আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং তার আদালত বর্জন ৪দিন ব্যাপী চলে। বর্জনের সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কক্সবাজার সফরের সময় নেতাদের অনুরোধে স্থগিত করা হয়েছিল,এখনও বাতিল করা হয় নাই। এই জন্য তার বিদায়ী সভায় আপ্রাণ চেষ্টার পরও বারের সভাপতি,সাধারণ সম্পাদক, পিপি, এপিপি, এজিপি ও সিন্ডিকেট সদস্যরা মিলে মাত্র ৪০জন যা মোট আইনজীবীদের ৪% এরও কম উপস্থিত ছিলেন।
উপস্থিত বিচারকদের মধ্যে যারা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখেছেন তা অত্যন্ত মূল্যবান,বাস্তব ও গুরুত্বপূর্ণ । আদালতের সম্মান না থাকলে আইনজীবীদেরও সম্মান থাকতে পারে না। আইনজীবীদের দায়িত্ব হল আইনানুগভাবে আদালতকে ন্যায় বিচার করতে সহায়তা করা,অন্য কিছু করতে সাহায্য করা নয়। আমাদের আইনজীবীদের জন্য অনুসরণীয় ৪২ ধারা আচরণবিধি ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জন্যও অনুসরণীয় ১৭ দফা আচরণবিধি যথাযথভাবে মেনে চললে বার এবং ব্যাঞ্চ এর মধ্যে কোন ভুল বুঝাবুঝি বা সমস্যা সৃষ্টি হবে না, ইনশাআল্লাহ।
চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট বলেছেন, তিনি প্রশংসা বা সমালোচনা পছন্দ করেন না। তিনি অপছন্দ বা রাগ করলেও আমাদের সত্য কথা বলতে হবে। তিনি আইনজীবীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন রোহিঙ্গা আরশা/আরএসও এর নিকট থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে নিজে ও নিজের পরিবারের সদস্যদের বিপদের ঝুকিতে ফেলবেন না। অপছন্দ করলেও বলবো, অতি সত্য কথা। চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে হিলটপ সার্কিট হাউসের নিচের ভুমি হলো বর্তমানে কক্সবাজারের সবচেয়ে মূল্যবান ও লোভনীয় জমি যাতে ১৪তলা ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সরকার। আমি সভাপতি থাকা কালে ১৯৯৬ সালে মির্জা গোলাম হাফিজের কাছে গিয়ে বার ভবন নির্মাণের জন্য সরকারী অনুদানের সাড়ে ৬ লক্ষ টাকা অনুমোদিত প্ল্যান অনুযায়ী খরচ করার শর্তে প্রাপ্ত হয়ে বর্তমান মূল ভবনের প্ল্যান করা হয়েছিল। এত দ্রæত কক্সবাজারে ১১/১২ শত আইনজীবী হবে তা আমরা কল্পনাও করি নাই। পরে বহুতল বিশিষ্ট এনেক্স ভবন নির্মাণ করার পর মনে হচ্ছে আরো বড় ভবন লাগবে। আমরা শত চেষ্টা করেও পরিবেশ আইন ভঙ্গ করে পুকুর ভরাট করে সরকারী ভবন নির্মাণ করাতে পারবো না। হৈ চৈ করে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ভবন নির্মাণ দীর্ঘায়িত করতে পারবো। আগে আদালতের সরকারী বন্ধ থাকতো সপ্তাহে একদিন রোব বার। পরে বিদ্যুৎ সা¯্রয় বা অন্যান্য কারণে শুক্রবার ও শনি বার দুইদিন বন্ধ ঘোষণা করলেও আইনজীবীদের পক্ষে সমালোচনা উঠেছিল দুইদিন বন্ধ থাকলে আমাদের অসুবিধা হবে,খাবো কি ইত্যাদি কথা। এখন কি সব চলছে না। আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের স্বার্থে মেনে নেওয়া উচিত। সস্তা জনপ্রিয়তা,সব কিছুতে রাজনীতি,দলীয়করণ ইতিমধ্যে আইনজীবী সমাজের ঐক্য,শক্তি,ভাবমূর্তি খন্ডিত করে ফেলেছে। সুপ্রীমকোর্ট সহ বিচার বিভাগের ভাবমূর্তির মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
বিচারপতি ভবানী প্রদাস সিংহ ১৯৮৯ সালে মোঃ আনোয়ার উল হক জেলা জজ ও আমি পিপি থাকা কালে কক্সবাজারের সাব-জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আবার ২০০১ সালে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে কক্সবাজারে যোগদান করেছিলেন। নবাগত জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ শাহীন উদ্দিনও কক্সবাজারে যুগ্ন জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে আগে তিন বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। এবার আবার জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে কক্সবাজারে যোগদান করেছেন। উনার নিষ্ঠা,সততা,যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পর্কে কক্সবাজারের আইনজীবীদের পূর্ব পরিচিতি আছে। উনিও কি শেষে যোগ্যতা বলে ভবানী প্রসাদ সিংহের মত হাইকোর্টের বিচারপতি হয়ে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাবেন?
লেখক : বিশিষ্ট কলাম লেখক, একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা, সাবেক সভাপতি, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি ও সাবেক পিপি।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।