‘জলবায়ু পরিবর্তন’ আজ বিশ্বের সকল মানুষের কাছেই একটি পরিচিত শব্দ। যার প্রভাব আজ বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই পড়লেও সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ষড় ঋতুর দেশ হলেও আজ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের আবহাওয়াও অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে।
ষড় ঋতুর বাংলাদেশের সঙ্গে আজ অনেক সময়ই মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আর আবহাওয়া পরিবর্তনে দেশের ফসল, মানুষের জীবনযাত্রা সব কিছুতেই ঘটেছে পরিবর্তন। সব মিলিয়ে মানুষের জীবনে বয়ে আনে মারাত্মক বিপর্যয়। তবে আবহাওয়ার এই পরিবর্তনে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের শিশুরা।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ছয় বছরের নিচে প্রায় ১.১৩ মিলিয়ন শিশু বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে অসুস্থ হয়। জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা- বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক এক জরিপে দেখা গেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ শিশুদের পড়াশোনার ক্ষেত্রেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। ওই সময় প্রায় ১.০৮ মিলিয়ন শিশু স্কুলে যেতে পারে না।
পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঢাকা শহরের ০-১৭ বছর বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশী ঝুঁকির মধ্যে থাকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সর্বমোট ১.৩১ মিলিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর মধ্যে ৪৮.৫৬ শতাংশ শিশু বন্যার কারনে অসুস্থ হয়ে পড়ে, ১২.১৫ শতাংশ অসুস্থ হয় জলাবদ্ধতার কারনে, ১২.১৪ শতাংশ অসুস্থ হয় ঘূর্ণিঝড়ের কারনে, ৬.৭৭ শতাংশ হয় খরার কারনে, ৫.৩৩ শতাংশ হয় বজ্রপাতের কারনে এবং ১৫.০৫ শতায়ংশ হয় অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘বাংলাদেশ দুর্যোগ সম্পর্কিত পরিসংখ্যান ২০১৫’: আবহাওয়া পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক জরিপের চিত্র এটি। ২০০৯- ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এটি প্রকাশিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝুঁকিতে থাকা এসব শিশু এবং তাদের পরিবারের বিষয়ে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিতে থাকে ঢাকার শিশুরা। ২০০৯ সাল হতে ২০১৪ পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে ঢাকা বিভাগের ২১.৭০ শতাংশ শিশু অসুস্থ হয়। যা রাজশাহী বিভাগে ছিল ১৫.৪৪ শতাংশ, সিলেট বিভাগে ১৩.৭৭ শতাংশ, বরিশালে ১৩.২৪ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১২.৭৫ শতাংশ, রংপুরে ১২.১৪ শতাংশ এবং খুলনা বিভাগে ১০.৯৬ শতাংশ।
বিভিন্ন বয়সী শিশুদের মধ্যে ৫-১২ বছর বয়সী শিশুরা সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। সর্বমোট ১.৩১ মিলিয়ন শিশুর মধ্যে ৫৪.২৪ শতাংশ ৫-১২ বছর বয়সী শিশু অসুস্থ হয়। এছাড়া ২৫.১৩ শতাংশ ০-৪ বছর বয়সী শিশু অসুস্থ হয়। বাকী ২০.৬৩ শতাংশ অন্যান্য বয়সী শিশু। আবার এসব শিশুর অধিকাংশই অসুস্থতার সময় তেমন কোন ভাল চিকিৎসা সেবা পায় না।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাত্র ১৯.৭০ শতাংশ শিশু কোন এমবিবিএস ডাক্তারের কাছ হতে চিকিৎসা সেবা পায়। সর্বোচ্চ সংখ্যক (২৬.০৪ শতাংশ) শিশু চিকিৎসা সেবা পায় প্যারা-মেডিকেল ডাক্তার, মেডিকেল সহকারী অথবা নার্সের কাছ থেকে, ২৩.৮৫ শতাংশ শিশু পায় ফার্মেসী থেকে, ২৩.৪৪ শতাংশ পায় গ্রাম্য ডাক্তারের কাছ থেকে, ৬.৩২ শতাংশ পায় অন্যান্যভাবে এবং ০.৬৫ শতাংশ কোন চিকিৎসা সেবাই পায় না।
পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, ১.০৮ মিলিয়ন ঝুঁকিগ্রস্থ শিশুর মধ্যে ৩৭.১৭ শতাংশ শিশু ৮-১৫ দিন স্কুলে উপস্থিত হতে পারে না, ৩৬.৬৫ শতাংশ পারে না ১-৭ দিন, ২১.৩৬ শতাংশ পারে না ১৬-৩০ দিন এবং ৪.৮৩ শতাংশ শিশু ৩১ দিনের অধিক স্কুলে উপস্থিত হতে পারে না। এসব শিশুর মধ্যে বরিশালের শিশুরা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দেখা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এই অঞ্চলের ২৪.৫৬ শতাংশ শিশু স্কুলে যেতে পারে না, যা ঢাকায় ১৮.৫৮ শতাংশ, সিলেটে ১৮.৩৪ শতাংশ এবং খুলনায় ৭.১৫ শতাংশ।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের শিশুরা। সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার বসবাসরত জনগণই সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। কারণ তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়। গত কয়েক বছর ধরে এসব এলাকায় ঝুঁকি বেড়ে গেছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব অঞ্চলের গরীব জেলে এবং কৃষকরা। তারা যখন ক্ষতিগ্রস্থ হয় তখন স্বাভাবিকভাবে তাদের সন্তানরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং স্কুলে উপস্থিত হতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, যখন এসব সমস্যা হয় তখন এসব শিশুদের খাদ্য এবং পুষ্টির সমস্যা হয় এবং তারা অপুষ্টিতে ভোগে। তাই সরকারের উচিত এসব এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্টীর জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এছাড়াও সরকারি ব্যাংক এবং অন্যান্য সংস্থা তাদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে পারে। যাতে তারা বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের জন্য স্কুলের সময়-সূচি সহজীকরনেরও দাবী জানান প্রাক্তন এই উপদেষ্টা।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।