শফিক আজাদ, উখিয়া : কয়েকদিনের জন্য রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কমে আসলেও মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আবারও দলে দলে বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের আট গ্রাম থেকে অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে এসেছে বলে দাবি করছেন রোহিঙ্গা নেতারা। তারা আরো জানান, রাখাইন প্রদেশে সেনা মোতায়েন নতুন করে সহিংসতা, বাড়ী-ঘরে আগুণ, এলাকা ছাড়তে রোহিঙ্গাদের রাখাইনদের মাইকিং করার পর থেকেই ওই এলাকা থেকে পালাচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা।বাংলাদেশে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নেতা আবদুল খালেক বুধবার এএফপিকে জানিয়েছেন, চলতি সপ্তাহে কমপক্ষে ৩ হাজার ৫শ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পৌঁছেছে। এছাড়াও সোমবার বিকেলে ফের উখিয়া সীমান্তের আঞ্জুমানপাড়া হয়ে বানের পানির মতো রোহিঙ্গা ঢল বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে করেছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার ওয়ার্ডের মেম্বার কামাল উদ্দিন। রোহিঙ্গা প্রবেশ বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে আবাসন ও স্যানিটেশন, ও চিকিৎসা সমস্যা। সরকারি বনভূমি ও পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে ঝুপড়ি ঘর। তবে পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি বলে দাবি করছেন সার্বিক বিষয়ে দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তাদের।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সেনা সদস্যদের অত্যাচারে দেশটির মংডু থানার প্রায় সব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন। সেনা সদস্যরা এখন বুচিদং ও রাছিদং এলাকার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় হামলা চালাচ্ছে। বাংলাদেশ সীমান্ত বদর মোকাম থেকে এ দুই থানার দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। বেশ কয়েকটি পাহাড়, বঙ্গোপসাগরের অংশ সামিলার দড়িয়া পাড়ি দিয়ে তারা বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া মায়ানমারের নাইক্ষাংদিয়া জড়ো হচ্ছেন। মিয়ানমার ত্যাগ করতে তারা নিচ্ছেন জীবনের ঝুঁকিও। বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে উখিয়া উপকূলে ট্রলারডুবির ঘটনায় ইতিমধ্যেই ২১ জন নিহত হয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন আরও অর্ধশতাধিক।রোহিঙ্গাদের নেতা ডা. জাফর আলম জানান, বুচিদং ও রাছিদং এই দুই থানার আওতাধীন ইয়াংমং, তিতারবিল, জাংগামা, মইদং, ছালিপাড়া, গোদাম পাড়া, সাংগামা, জোপাড়া ও প্রিংডম গ্রাম থেকে সোমবার অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমারের মেদি হয়ে নাফ নদী পার হয়ে এপারে উঠে। পরে এ সব রোহিঙ্গা উখিয়ার বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে।অনুপ্রবেশকারী সাংগামা থেকে পালংখালী শফিউল্লাহ কাটা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া খলিলুর রহমান (৪৫) জানান, ২০ সেপ্টেম্বর অংসান সুচি সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু ২১ তারিখ থেকে সেনা সদস্যরা গ্রামে ঢুকে ঘরবাড়িতে আগুন দেয়। গরু-ছাগল হাস-মুরগী লুটপাট করে। এতে রোহিঙ্গারা আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফলে এ সব গ্রামের রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসতে শুরু করেছে। মিয়ানমারের বুচিদং থানার থামি থেকে পালিয়ে আসা কামাল হোছনের স্ত্রী দীলদার বেগমের (২৫) সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন পাহাড় টিলা ও মেটোপথ পাড়ি দিয়ে ছয় দিন খেয়ে না খেয়ে তিনি নাইক্ষংদিয়া পৌঁছেছেন। সেখান থেকে সাগর পথে বালুখালী অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তিনি আশ্রয় নেন।বাংলাদেশ-মিয়ানমারকে বিভক্ত করা নাফ নদীর কাছাকাছি কক্সবাজার এলাকায় ইতোমধ্যেই শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে অতিরিক্ত লোকজনে গাদাগাদি করে থাকছে। সেখানে আরো রোহিঙ্গারা এসে আশ্রয় নেওয়ার কারনে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ওই এলাকায় টহল দেয়ার পরেও রোহিঙ্গারা দেশটিতে প্রবেশ করছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বলছেন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের কে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।
বালুখালি ক্যাম্পের মাঝি লালু মিয়া জানান, সম্প্রতি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর শুধু বালুখালী ক্যাম্পে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে নতুন করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের স্থান কোথায় হয় সেটা আল্লাহ জানে। অথচ তারা রাখাইনে নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। ওই ক্যাম্পটি সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের পর প্রথমে সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছে।
সরেজমিন সোমবার উখিয়ার থাইংখালী তাজমিরখোলা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া মোহাম্মদ উল্লাহ (৩৪) জানান, তিনি রাখাইনের ছিটুয়ে থেকে পালিয়ে এসেছেন। মিয়নামার সেনারা সেখানে তল্লাশির নামে অভিযান শুরু করেছে। এতদিন তাদের কোথাও পালিয়ে না যেতে এবং তাদের নিরাপত্তা দেয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়ে রেখেছিল সেনাবাহিনী। এখন তার মনে হচ্ছে, এ ধরনের মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের হত্যা ও নিশ্চিহ্ন করার জন্যই। বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয়ের জন্য আসা রোহিঙ্গা নুর মোহাম্মদ (৫৫) জানান, মংডুর ছৈঝাপাড়া, উকিলপাড়া, মংনিপাড়া, তামির ও বুচিদংয়ে আরও অন্তত ৫ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছেন। তাদের মিয়ানমার সেনাবাহিনী ঘিরে রেখেছে যাতে পালিয়ে আসতে না পারেন। সেখানে অনেক রোহিঙ্গা মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে মারা যাচ্ছেন বলেও জানান তিনি। সোমবার অনুপ্রবেশ করে থাইংখালী স্কুল মাঠের অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া বুচিদং এলাকার জান্নাতুল ফেরদৌস (২৫) জানান, ৪ দিন ধরে দুর্গম পথ হেঁটে পরিবারের ১৭ সদস্য নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে কমপক্ষে ৫০ হাজারের মতো রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সদ্য অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের দাবি, উত্তর মংডু ছাড়াও আকিয়াব ও ছিটুয়ে অঞ্চলের রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সেনাদের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচতে দলে দলে সীমান্তে এসে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছেন।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।