ভু-গর্ভস্থ পানি স্থর স্বাভাবিক ভাবে ২০-২২ ফুট পর্যন্ত গভীরে থাকার কথা। এ গভীরতার মধ্যে পানি স্থর বা লেয়ার থাকলে পর্যাপ্ত পরিমানের সুপেয় পানি পাওয়া যায়। অথচ কক্সবাজারের উখিয়ার সর্বত্র ভূ-গর্ভস্থ পানিস্থর আশংকাজনক হারে নেমে দাঁড়িয়েছে গড়ে ৪০-৪৫ ফুট নিচে। কোথাও সেটি ৫০ ফুটের কাছাকাছি। চৈত্রের প্রচন্ড কাঠ ফাঁটা রোদ ও তাপদাহে উখিয়ার সর্বত্র পানির জন্য হাহাকার চলছে। বিশেষ করে স্কুলগামী শিশু, গৃহীনি ও কৃষকরা পানি নিয়ে পড়েছে চরম বিপাকে। চিকিৎসকরা এ অবস্থায় শিশুদের মাঝে নানা অসুখ বিসুখের আশংকা করছেন। নির্বিচারে পাহাড় টিলা, বন নিধন, প্রকুর-জলধার ভরাট করা, খাল-নদী মাত্রাতিরিক্ত গলিতে ভরাট হওয়া, ভু-গর্ভস্থ পানির উৎস থেকে অধিক মাত্রায় পানি উত্তোলন সহ প্রভৃতি কারণে চলতি শুষ্ক মওসুমে এখানে ব্যাপক আকারে পানির সংকট দেখা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের দাবী। এসব কারণে বর্তমানে উখিয়ার ইতি মধ্যে অন্তত ৫ হাজার অগভীর নলকূপ বা টিউবওয়েল অচল হয়ে পড়েছে এবং ১২ হাজার একর ইরি-বোরো চাষাবাদ হুমকির মধ্যে পড়েছে। এতে সমূদ্র পৃষ্টের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার উপকূলীয় এলাকায় লবনাক্ততার হারও বাড়ছে।
উখিয়ার পশ্চিম মরিচ্যার কৃষক আব্দুল বারী, সুবল বড়–য়া বলেন, যুগযুগ ধরে মরিচ্যা গোয়ালিয়া খাল থেকে পানি সেচে ইরি-বোরো চাষ করতাম। কিন্তু ২/৩ বছর ধরে জোয়ারের প্রভাবে সমূদ্রের লবনাক্ত পানি খালে আসায় এখালের পানি আর সেচ কাজে ব্যবহার করা যায় না। জালিয়াপালংয়ের পাইন্যাশিয়া কদমতলীর কৃষক আবুল বশর মেম্বার, আব্দুল মতলব, আলী হোসেন বলেন, রেজুখালের দক্ষিণ পাড়ে আমাদের বসতি ও চাষাবাদ, কিন্তু সাম্প্রতিক বছর গুলোতে বঙ্গোপসাগরের মোহনা রেজু নদীতে অধিক পরিমানের জোয়ারের পানি চলে আসায় বেশ কিছু জমিতে শুষ্ক মওসুমে চাষাবাদ না করে খিল রাখতে হয়েছে। এভাবে মরিচ্যা গোয়ালিয়া খালে, ধুরুমখালী খাল, কুমারপাড়া রেজুখাল, ইনানী ছোট ও বড় খাল, ছেপটখালী খাল, মনখালী খাল পাড়ের বিস্তর জমিতে শুষ্ক মওসুমে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। তারা জানায় এসব খাল গুলো বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে এবং সমূদ্রের জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব পানি খালের অনেক ভিতরে চলে আসায় মিঠা পানির অভাবে ইরি বোরো চাষাবাদ বিঘœ ঘটছে।
রাজাপালং ইউনিয়নের ডেইলপাড়া গ্রামের কৃষক হোসেন আহমদ, জালাল আহমদ মাষ্টার, ডিগলিয়া গ্রামের শাহজাহান, টাইপালং গ্রামের নুর আহমদ মেম্বার, আলী চান্দ মেম্বার সহ অসংখ্য কৃষক বলেন, বার্মার ওয়ালি ডং পাহাড় থেকে আসা রেজু খালের বিভিন্ন শাখা যেমন ডেইলপাড়া খাল, টাইপালং খাল, ডিগলিয়া, সিকদার বিল, পুকুরিয়া-হিজলিয়া খাল, দোছড়ী খাল-হরিণমারা খাল, তুতুরবিল খাল, ধুরুমখালী খাল, পাতাবাড়ি-হলদিয়া-বড়বিল খাল গুলো রেজু নদীর সাথে মিশে সোনারপাড়া দিয়ে বঙ্গোসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে। তাদের মতে গত কয়েক দশকে নির্বিচারে পাহাড় টিলা কর্তন, বন- বাঁদোড় উজাড় এবং যত্রতত্র মাটি কেটে রাস্তা, ঘর-বাড়ী স্থাপনা নির্মাণ সহ নানা কারণে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টন মাটি ও পলি ক্ষয়ে এসব খালে পড়ে ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়েছে। ৯০ দশকের গোড়া পর্যন্ত এসব খালে শুষ্ক মওসুমে পানিতে ভরপুর ছিল। স্থানীয় কৃষকরা সমবায় সমিতির মাধ্যমে বি.এ ডিসির পাম্পের সাহায্যে ইরি চাষাবাদ করত। এতে পানির কোন সংকট ছিল। চাষাবাদ শেষে খাল গুলোতে দেওয়া অস্থায়ী বাঁধ কেটে স্থানীয়রা দলে দলে মাছ ধরত। পাওয়া যেত অসংখ্য প্রজাতির বিলের মথুরা পানির মাছ। তাদের দাবী এগুলো এখন শুধু স্মৃতি। উল্লেখিত এসব খাল গুলো বর্তমানে মাটি ও পানিতে ভরাট হয়ে যাওয়ায় চর পড়ে অস্থিত সংকটে পড়েছে। কোন খালে বর্তমানে পানি নেই। এসব এলাকার ক্ষতিগ্রস্থরা বলেন, পেঠের দায়ে গবাদি পশুর কথা ভেবে লোকজন লোকসানের পরও চাষাবাদ করে যাচ্ছে। তবে খাল বা উম্মুক্ত জলধার বা ভুপরিস্থ পানির বদলে কৃষকরা বাধ্য হয়ে শত শত নলকুপে বৈদ্যুতিক ও ডিজেল চালিত পাম্প বসিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে চাষাবাদ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। তাদেরও অভিমত এতে মাটির নিচে শূণ্য হয়ে পড়ছে এবং ভূমিকম্পের মত বড় বিপদ ধেয়ে আসছে।
উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ ফিরোজ খান বলেন, বর্তমান প্রতিকূল আবহাওয়া, প্রচন্ড তাপদাহ মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে অধিক দুর্বল, মাথা ব্যথা, পেঠ ব্যথা সহ নানা পানি জনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে শিশুরা এ অবস্থায় অধিক হারে আক্রান্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ার আশংকা থাকে। উখিয়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের উপ সহকারী প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন বলেন, উখিয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানি স্থর আশংকাজনক হারে প্রতি বছর নিচে নেমে যাচ্ছে। সাড়ে ৩৭ হাজার পরিবারের মধ্যে সরকারী ও ইউনিসেফের মাধ্যমে স্থাপিত প্রায় ২ হাজারটি নলকূপ রয়েছে। তৎমধ্যে ৪১১ টি গভীর নলকুপ। গভীর নলকুপ ছাড়াও অগভীর নলকুপে এখানে বিশেষ কৌশলে সাবমারসিবল পাম্প বেিসয় ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে এখানে পানি তোলা হচ্ছে। শুষ্ক মওসুমের ৮০ শতাংশ চাষাবাদের সেচ দেওয়া হয় ভূ-গর্ভস্থ পানি দিয়ে। এখানে ভূ-গর্ভস্থ পানিস্থর গড়ে ৪০-৪৫ ফুট পর্যন্ত নিম্নমূখী। জালিয়াপালং ইউনিয়নে মাটির নিচে পাথরের স্তুপ থাকায় সর্বোচ্চ ৩০ ফুট পর্যন্ত গভীরে গিয়ে নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব হয়। এর বেশি গভীরে যাওয়া কঠিন। বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এ ইউনিয়নে বর্তমানে পানি স্থর ২০-২২ ফুট নিচে নেমে গেছে। এখানে সুপেয় পানির কঠিন সংকট চলছে। এছাড়া উখিয়ার সর্বত্র গড়ে ৪০-৪৫ ফুট পর্যন্ত পানিস্থর নিচে নেমে গেছে। তবে উদ্বেগ জনক হারে রতœাপালং ইউনিয়নে গড়ে ৪৫-৫০ ফুট পর্যন্ত পানি স্থর নিচে নেমে যাওয়ায় এসব এলাকার সিংহভাগ নলকূপ অচল হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারি ও মার্চ-এপ্রিল মাসে প্রতি বছর ৪ বার পানিস্থর পরীক্ষা করে বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে উচ্চ পর্যায়ে প্রতিবেদন প্রেরণ করা হয়েছে। এখানে সরকারী হিসাব ছাড়াও ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং বিভিন্ন এনজিও প্রদত্ত আরো প্রায় ৭ হাজারের মত গভীর, অগভীর নলকূপ রয়েছে। যে গুলোর পানির গুনাগুন সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য প্রকৌলশ অফিসে সঠিক কোন তথ্য নেই। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, উখিয়ার প্রায় ৮০ শতাংশ নলকূপ বর্তমানে পানিস্থর নিচে নেমে যাওয়ায় অচল হয়ে পড়েছে। ফলে স্থানীয় লোকজন ১৫-৩০ ফুটের মধ্যে স্বল্প গভীরতায় নলকূপ স্থাপন করে একে বারে উপরে স্থরের পানি পান করছে। এসব পানি অনিরাপদ এবং এগুলো অনেক ক্ষেত্রে নানা ধরণের রোগ জীবাণু ছড়াতে পারে। পরিবেশের ভারসাম্য ও জলবায়ূ পরিবর্তন জনিত কারণে উখিয়ায় প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ সম্পূর্ণ ভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল হওয়ায় যে ভাবে পানি স্থর প্রতি বছর আশংকাজনক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে সেগুলো বিবেচনায় এনে ভূ-পরিস্থ পানি ব্যবহারে লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ এখানে নলকূপ স্থাপনের বিকল্প চিন্তা ভাবনা করছে। উখিয়া কৃষি অফিস চলতি ইরি-বোরো মওসুমে কি পরিমানের জমিতে চাষাবাদ হয়েছে এবং কতটি সেচ পাম্প রয়েছে তার সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। উখিয়া পল্লী বিদ্যুতের ডেপুটি জোনাল ম্যানেজার মোঃ নূরুল হোসাইন বলেন, চলতি ইরি-বোরো সেচ মওসুমে উখিয়ায় চাহিদা অনুপাতে বিদ্যুতের সরবরাহ ভাল। এখানে বিদ্যুৎ সংকট অনেকটা কেটে গেছে। এ বছর উখিয়ায় ইরি-বোরো চাষাবাদে সেচের জন্য ১৪৫৬ টি সেচ পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।