১২ মে ১০১৫, মঙ্গলবার।
সময় কতো হতে পারে! বেশি হলেও দুপুর ১২টা গড়িয়েছে! তখনই পেলাম ‘মনফাটানো’ খবরটি।
‘ভারতের মেঘালয়ে সালাহউদ্দিনের সন্ধান মিলেছে!’
খবরটি যখন আমি প্রথম শুনলাম তখন আমি ছিলাম কক্সবাজার শহর থেকে অনেকটাই দূরে, টেকনাফ শহরে! গিয়েছিলাম পেশাগত কাজে। মাত্রই টেকনাফ শহরে গাড়ি থেকে নেমেছি। ওই সময় হেলালী ভাইয়ের (নূরুল ইসলাম হেলালী) মোবাইলে একটি কল আসলো। একজন জানালেন, টিভি স্ক্রলে ব্রেকিং যাচ্ছে, ‘সালাহউদ্দিন আহমদ মেঘালয় থেকে স্ত্রী হাসিনা আহমদের সাথে ফোনে কথা বলেছেন!’
শুনেই আমি একটি ছোট্ট টুলে বসে পড়লাম। আমার শরীরজুড়ে হিমশীতল কী যেন একটা বয়ে গেল। আমার মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না! মুখ দিয়ে কথা না বেরুলে কী হবে, অন্তর কিন্তু সেই মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেই চলেছে!
এই খবরে সবাই সাধারণত স্বস্তি পাওয়ারই কথা! আমিও সালাহউদ্দিনের বেঁচে থাকার খবরে স্বস্তি পেলাম, সাথে সাথে কিছুটা উদভ্রান্তের মতো হয়ে গেলাম। আমার সফর সঙ্গীদের বললাম, ‘চলেন, কক্সবাজার ফিরে যাই! আমার মন কেমন জানি করছে!’ এই ফাঁকে ইউসুফ ভাইও (বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ইউসুফ বদরী) একবার ফোন দিলেন, আমি যেন কক্সবাজার ফিরে আসি।
দ্রুত কয়েকটি অনলাইন চেক করলাম। তখনও দুয়েকটি অনলাইন ছাড়া বেশি অনলাইনে খবরটি আসেনি। দুয়েকটি অনলাইনে যা পড়লাম তার সারসংক্ষেপ হলো, সালাহউদ্দিন আহমদ ‘উদভ্রান্তে’র মতো শিলং গলফ লিংকের কাছে ঘুরছিলেন! পুলিশ তাঁকে ধরে থানায় নিয়েছে। পরে ওখান থেকে মেন্টাল হাসপাতালে!
সালাহউদ্দিন আহমদ শিলংয়ে ‘উদভ্রান্তে’র মতো ঘুরছিলেন! সেই খবর শুনে আমিও কিছুটা ‘উদভ্রান্তে’র মতো হয়ে গেলাম! তাঁর বেঁচে থাকা, তাঁকে ফিরে পাওয়ার আনন্দেই হয়তো কিছুটা অচেনা পরিবেশ ছেড়ে কক্সবাজারের চেনা পরিবেশে ফিরে আসতে মন চাইছিল! এখানেই হয়তো নিজের অনুভূতিটাকে শেয়ার করা যাবে অনেকের সাথেই!
সত্যিকার অর্থে মানবপাচার নিয়ে সরেজমিন করার যে আশা নিয়ে টেকনাফ গিয়েছিলাম, তা আর হলো না! দুপুরের খাবারটা একটা রাস্তার হোটেলে খেয়ে ফিরে আসলাম কক্সবাজার।
মন তখনও আকুলি-বিকুলি করছিল! আর যা-ই হোক, সালাহউদ্দিন আহমদ তো বেঁচে আছেন! অসুস্থ হোক, ‘উদভ্রান্ত’ হোক, ‘মেন্টাল’ হোক, এই মুহুর্তে তাঁর বেঁচে থাকার খবরটাই তো জেলাবাসির কাছে স্বস্তির কারণ হয়ে এসেছে!
সালাহউদ্দিন আহমদের সন্ধান পাওয়ার মাত্রই দুইদিন আগে আমার আর জেলাবাসির আকুতি নিয়ে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলাম, ‘সালাহউদ্দিন আহমদকে আজ আমাদের বড়ই প্রয়োজন’! ওই প্রতিবেদনে মহান ¯্রষ্টা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর কাছে যে আকুতি দিয়ে আমার লেখা শেষ করেছিলাম তা ছিল এই রকম, ‘হে আমার জীবনদাতা মহান আল্লাহ, তোমার ইচ্ছার বাইরে কিছুই হয় না। নিশ্চয় তুমি সালাহউদ্দিন আহমদকে, সাথে পুরো জেলাবাসিকে পরীক্ষায় ফেলেছো। তাঁর জীবনের রশিটা যদি তোমার হাতে রেখে থাকো, তাহলে সেই রশিটা কী একটু ছাড়া যায় না!’
‘তুমি তো পরম দয়ালু, ক্ষমাশীল, রিযিক ও জীবনদাতা।’
তবে কী মহান আল্লাহ আমার কথা শুনেছেন! এমন কথা মুখে আনার কোন যোগ্যতাই আমার নাই। তবে আল্লাহর কোন না কোন বান্দার ‘সালাহউদ্দিনকে ফিরে পাওয়ার আকুতি’ নিশ্চয় আল্লাহ শুনেছেন! আর শুনেছেন বলেই সালাহউদ্দিন আহমদ বেঁচে আছেন। আর এই স্বস্তিতেই আজ পুরো দেশবাসি পুলকিত।
মহান আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন, জীবন এবং মৃত্যুর মালিক একমাত্র তিনিই। তিনি যাকে চান জীবন দেন, আর যাকে ইচ্ছা মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করান! কিন্তু কোন মানুষ চাইলেই কাউকে মৃত্যুর স্বাদ দিতে পারেন না। সালাহউদ্দিন আহমদ সেই উদাহরণের উজ্জল প্রমাণ!
আমরা কী সেই ¯্রষ্টার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো না! যদিও তিনি কারো কৃতজ্ঞতার মুখাপেক্ষী নন।
সালাহউদ্দিন আহমদ ‘নিখোঁজ’ হয়েছিলেন ২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাতে। তারপর একেকটি দিন গেছে, একেকটি রাত গেছে অস্বস্তিকর কালো বাতাস যেন বইছিল সবখানে। সালাহউদ্দিন কী বেঁচে আছেন! নাকি অন্য অনেকের মতো তাঁকেও গুম-খুন করে ফেলা হয়েছে! তিনি ‘বেঁচে নেই’ এমন বিশ্বাসিদের সংখ্যাও যেন দিনে দিনে বাড়ছিল। এমন বিশ্বাসিদের অনেকেরই একটি বাক্য ছিল, ‘না না, তিনি আর নেই! এতোদিনে তাঁর হাড্ডিমাংসও মাটিতে মিশে গেছে!’
তবে এখানে একটি কথা বলে যাই, এমন বিশ্বাসি ছিলেন মাত্রই হাতেগোনা! আর বেঁচে থাকার বিশ্বাসি তো ছিলেন পুরো জেলাবাসি।
এইখানে ‘আবেগ’ আর ‘প্রতিহিংসা’ যেন হাত ধরাধরি করে চলছিল!
যাদের সাথে, যাদের জন্য সালাহউদ্দিন আহমদ রাজনীতি করছেন তাদের অনেকেই হয়তো তিনি ‘নিখোঁজ’ হওয়ার পর যেমনটি হওয়ার কথা ছিল তেমন ভাবে হয়তো আবেগ দেখাননি ঠিকই, কিন্তু যাদের সাথে সালাহউদ্দিনের ব্যক্তিগত কোন সম্পর্ক নেই, যাদের সাথে হয়তো কখনোই তাঁর দেখা হয়নি এমন মানুষদের মাঝে তাঁর জন্য আকুতি ছিল অনেক বেশি, অনেক বেশি আন্তরিক।
লেখার এই পর্যায়ে এসে আরেকবার মনটা আমার হু হু করে উঠলো! কেন?, সালাহউদ্দিনের জন্য কী!
এই মানুষটি ব্যক্তিগত ভাবে আমার কোন নিকটাত্মীয় নন, তবুও কেন জানি না তাঁর জন্য অন্তরটা পুড়ছেই! কারো জন্য ভালোবাসা জোর করে তৈরি করা যায় না! সেটা আপনাতেই অন্তরে জন্ম নেয়! সালাহউদ্দিন আহমদের জন্য আমার অন্তর পোড়াটাও তেমনই!
তবে কী তিনি আমার মনের কোন অন্দরমহলে ঢুকে গেলেন!
সালাহউদ্দিন আহমদ ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন! এই ‘নিখোঁজ’ হওয়ার পর থেকে অনেকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে দোয়া-মিলাদ করেছেন। খতমের পর খতম দেয়া হয়েছে পবিত্র কোরআনের। রোজা রেখেছেন অনেকেই! তাদের একটাই আকুতি, সালাহউদ্দিন আহমদকে আল্লাহ যেন সহিসালামতেই ফিরিয়ে দেন! সালাহউদ্দিন আহমদ হয়তো কখনোই জানতে পারবেন না, তাঁকে অন্তর থেকে ভালোবেসে যাওয়া এই মানুষগুলোর কথা!
তবে তাঁর ‘খোঁজ’ পাওয়ার পর এক পরিচিতজনের কাছে শুনলাম, সালাহউদ্দিন আহমদ নাকি নিজেই বিশ্বাস করছেন মহান আল্লাহই আবার তাঁকে জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন আর নাম না জানা জেলাবাসি, দেশবাসি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছেন বলেই তিনি আবার ফিরে আসতে পেরেছেন!
মেঘালয়ের শিলং থেকে পাঠানো জাতীয় গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে দেখলাম, ‘যখন আমার চোখ ও হাত বেঁধে ফেলা হলো তখন ধরেই নিয়েছিলাম আজ আমার জীবনের শেষ রাত!’ সালাহউদ্দিন আহমদ এভাবেই নিজের অনুভূতির কথা তুলে ধরে দেশ থেকে শিলংয়ে ছুটে যাওয়া সাংবাদিকদের বলেছিলেন!
তাঁর নিকটজনদের কাছে শোনা, বাংলাদেশ থেকে সাংবাদিক যাওয়ার আগে শিলংয়ের স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আপনারাও আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখুন, একমাত্র আল্লাহই পারেন আপনাদের বাঁচাতে!’
তিনি হয়তো ছিলেন ঘোরের মধ্যে! তিনি তখনও বুঝতেই হয়তো পারছিলেন না, যাদের তিনি মহান ‘আল্লাহ’র কথা বলছিলেন তাদের অনেকেই একজন আল্লাহতে বিশ্বাসি নন! সালাহউদ্দিনের হয়তো মনেই আসেনি, সেই সকল সাংবাদিকদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন ‘অবিশ্বাসি’!
এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে যাওয়া যেতে পারে।
সালাহউদ্দিনের শিলং যাত্রা!
২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাতে সালাহউদ্দিন আহমদ ঢাকার উত্তরার একটি ভবন থেকে ‘অপহৃত’ হয়েছিলেন। যেহেতু আইন শৃংখলা বাহিনীর কোন শাখায় আজ পর্যন্ত তাঁকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করেনি, তাই তিনি ‘অপহৃত’ হয়েছেন বলায় সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত।
তিনি দুই মাস দুই দিন পর ভারতের পাহাড়বেষ্টিত এলাকা মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে ‘উদয়’ হলেন! অনেক মিডিয়া ও বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিক ‘উদয়’ শব্দটিই সালাহউদ্দিনের জন্য ব্যবহার করেছেন। ধরলাম, তিনি ‘উদয়’ হলেন! কিন্তু কিভাবে তিনি সেখানে ‘উদয়’ হলেন সে ব্যাপারটি জানতে কোন মিডিয়া অনুসন্ধানি কোন চেষ্টা চালায়নি। সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও ‘রাজনীতির ভাষা’য় কথা বলেছেন, ‘সালাহউদ্দিন আহমদ নিজেই পালিয়ে শিলং গেছেন’!
তাদের কথা শুনে ‘আফসোস’ বলা ছাড়া কোন উপায় খুঁজে পাই না আমি!
যারা এসব কথা বলছেন, আমার বিশ্বাস, তাঁরা সালাহউদ্দিন আহমদকে চিনেনই না! তাঁকে চিনলে এমন কথা মুখ দিয়েই বেরুতো না তাদের!
যদি ধরেও নিই, সালাহউদ্দিন আহমদ নিজে থেকেই আত্মগোপন করেছেন, তারপরও তিনি পালিয়ে ভারত যাওয়ার মানুষ নন। তিনি দেশ ছেড়ে পালাবেন এমন কথা হয়তো তাঁর দুষমনরাও বিশ্বাস করবেন না!
তাহলে তিনি কিভাবে শিলং পৌছালেন?
মিডিয়ায় প্রকাশিত নানা প্রতিবেদন থেকে যেটা দিবালোকের মতো সত্য, তিনি নিজের চেষ্টায় ভারতে অনুপ্রবেশ করেননি। যারাই তাঁকে ‘অপহরণ’ করেছিল তারাই হয়তো সীমান্ত পার করে পাহাড়ি পথে শিলং পর্যন্ত পৌছে দিয়েছেন। সালাহউদ্দিন নিজেও মিডিয়ার কাছে বলেছেন, চোখ বেঁধে দীর্ঘ পথ গাড়ি চালিয়ে তাঁকে শিলং গলফ লিংকের কাছে ছেড়ে দেয়া হয়েছে! আর তিনি চোখের বাঁধন খুলে স্থানীয় লোকজনের কাছে এলাকার পরিচয় জেনেছেন। পরে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন।
সালাহউদ্দিন আর যা-ই করুন, ‘উদভ্রান্তে’র মতো অন্য একটা দেশে শূণ্য পকেটে ঘুরবেন না! তাও আবার এক কাপড়ে! তবে তাঁর গায়ে জড়ানো চাদর নিয়ে নানা ধরণের গুজব ঢালপালা ছড়িয়েছে।
এখন জানতে ইচ্ছে করছে, তাহলে তিনি ওখানে গেলেন কিভাবে? এই প্রশ্নের সাথে সাথে আরও বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়! এই প্রশ্ন অস্বাভাবিকও নয়।
প্রশ্ন নাম্বার এক, সালাহউদ্দিন আহমদকে সীমান্ত পার করানো হয়েছে। তখন বিজিবি-বিএসএফ কী করছিল?
প্রশ্ন নাম্বার দুই, সালাহউদ্দিন আহমদকে চোখ বাঁধা অবস্থায় গাড়িতে চড়িয়ে দীর্ঘ পাহাড়ি পথে শিলং নেয়া হয়েছে। এই দীর্ঘ পথে একজন চোখ বাঁধা মানুষকে কিভাবে নেয়া গেল?
প্রশ্ন নাম্বার তিন, সালাহউদ্দিন আহমদের এই যাত্রায় কী দুই দেশের বাহিনী পর্যায়ে কোন সম্পর্ক ছিল?
প্রশ্ন নাম্বার চার, সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, তিনি নিজেই শিলং পুলিশের কাছে গেছেন। তাহলে শিলং পুলিশ মিডিয়ার কাছে মিথ্যা বললো কেন?
প্রশ্ন নাম্বার পাঁচ, সালাহউদ্দিন আহমদ যখন শিলং পুলিশের কাছে গেলেন তখন তাঁর শারিরিক অবয়ব কেমন ছিল? মিডিয়ায় প্রকাশিত শিলংয়ে সালাহউদ্দিন আহমদের প্রথম ছবি নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে! ‘তিনি কেন ক্লিন শেভড’!
তবে যতদূর খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সালাহউদ্দিন আহমদ যখন শিলং পুলিশের কাছে পৌছান তখন তাঁর হাত-পায়ে ছিল লম্বা লম্বা নখ, মুখে লম্বা দাড়ি-গোফ। হাতে ছিল একটি ওষুধের পুটলি! ওই অবস্থায় দেখেই তো শিলং পুলিশ সালাহউদ্দিন আহমদকে ‘উদভ্রান্ত’ ও ‘মানসিক বিকারগ্রস্থ’ ভেবেছিল।
সালাহউদ্দিন আহমদকে ‘মেন্টাল’ হাসপাতালে নেয়ার পরই তাঁর হাত-পায়ের নখ কাটা হয়, মুখের দাড়ি-গোফ কামানো হয়। তারপর ‘ক্লিন শেভড’ ছবি তুলে ‘একজন বাংলাদেশি’ আটকের ছবি মিডিয়াকে সরবরাহ করা হয়।
তারও আগে আমার ‘শূণ্য’ নাম্বার প্রশ্ন, শিলং যাওয়ার আগে দুই মাস সালাহউদ্দিন আহমদ কোথায় ছিলেন? কিভাবে ছিলেন? কারা তাঁকে তুলে নিয়েছিল?
সালাহউদ্দিনের ‘স্মৃতিভ্রম’!
মেঘালয়ের শিলং সিভিল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় গণমাধ্যমে বেশ কিছু প্রতিবেদন দেখলাম। সালাহউদ্দিন আহমদের ‘স্মৃতিভ্রম’ হয়েছে! তিনি বন্দিজীবনের তেমন কিছুই মনে করতে পারছেন না! ঘটনা কী সত্য নাকি!
কিন্তু তিনি যখন হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে হাসপাতালের মূলভবনে শারিরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যাচ্ছিলেন তখন বাংলাদেশি টিভি সাংবাদিকরা তাঁকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছিলেন। ওইদিনই তিনি ‘বন্দিত্ব’ থেকে মুক্ত হওয়ার পর ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার সাথে প্রথম কথা বলেছেন। যারা এই প্রতিবেদন দেখেছেন, কিংবা যারা লাইভ দেখেছেন, আপনাদের কী মনে হয়েছে সালাহউদ্দিন আহমদের ‘স্মৃতিভ্রম’ হয়েছে! তিনি তো সবকিছু আগের মতোই আগের ঢংয়েই বলছিলেন মিডিয়ার সামনে! শুধু একটু পার্থক্য ছিল, শারিরিক দূর্বলতার জন্য কথা বলতে হাপিয়ে উঠছিলেন!
আমি যতদূর জানি, সালাহউদ্দিন আহমদের স্মৃতিশক্তি এতোই প্রখর যে, কারো সাথে একবার দেখা হলে তার সাথে দশ বছর পরও যদি তাঁর দেখা হয় তিনি নাম ধরেই ওই ব্যক্তিকে ডাকতে পারেন! তিনি প্রতিটি ঘটনাক্রম মনে রাখতে পারেন!
ধরা যাক, তিনি ‘বন্দি’ থাকাকালে মানসিক নির্যাতনে কিংবা অন্য কোন উপায়ে তাঁর স্মৃতিশক্তি নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর যদি ‘স্মৃতিভ্রম’ই হয় তাহলে তিনি পুলিশে গেলেন কিভাবে! তিনি কিভাবে বলতে পারলেন, তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন! বিরোধী দলের একজন সিনিয়র নেতা তিনি!
আসলে সালাহউদ্দিন আহমদের মতো মানুষদের ‘স্মৃতিভ্রম’ হয় না। প্রবল ইচ্ছা শক্তিই সালাহউদ্দিনদের মতো মানুষদের ‘স্মৃতিভ্রম’ করাতে পারে না!
আমরা ধরে নিতে পারি, যদি তিনি ‘বন্দি’কালিন সময়ের কথা না বলেন তাহলে ধরে নিতে হবে, এখন তিনি কিছু বলতে চাচ্ছেন না! হয়তো এই জীবনে ফেলে আসা দুই মাস দুইদিনের কথা কখনোই কাউকে বলবেন না তিনি!
তবে সালাহউদ্দিন আহমদের স্মৃতিভ্রম হয়নি। তিনি সবকিছু মনে রেখেছেন! যারা এই দুইমাসে তাঁর জন্য কিছু করেছেন তাদের কথা, যারা কিছুই করেননি তাদের কথাও!
রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা!
সালাহউদ্দিন আহমদকে মেঘালয়ে পাওয়ার পর বেশ কিছু মিডিয়ায় একটি খবর বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে, সালাহউদ্দিন ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারেন! ওই প্রতিবেদন দেখেই আমি ফিক করে হেসে ফেলেছি! আমি আমার কাছের অনেককেই বলেছি, যারা এই রিপোর্ট করেছেন তারা সালাহউদ্দিনকে চেনেন না! তারা তাঁকে চিনলে এমন রিপোর্ট কখনোই লিখতেন না!
সালাহউদ্দিন আহমদকে যারা ভালো জানেন, তারা নিশ্চয় জানেন তিনি অন্য দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার মানুষ নন!
প্রশ্ন আসতে পারে, কেন তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারেন না!
সালাহউদ্দিনকে যারা চেনেন, তারাই জানেন তিনি কোন জাতের মানুষ! সালাহউদ্দিন আহমদের মানসিক দৃঢ়তা এতো বেশি যে, কোন বড় দূর্যোগও যদি তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায় তিনি কখনো এক মুহুর্তের জন্য বিচলিত হন না! রাজনৈতিক ‘গুমবাজি’, ‘মামলাবাজি’ কিংবা কোন বাহিনী তাঁর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালানোর মতো ঘটনাও তিনি হাসিমুখে নিতে পারেন!
একটি ঘটনা বলা যেতে পারে। ওয়ান-ইলেভেন সরকার তখন মাত্রই ক্ষমতায় বসেছেন। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের উপর দমন-পীড়ন শুরু হয়েছে। ওই সময় সেনাবাহিনী ও র্যাব সালাহউদ্দিনকে খুঁজছে। তাঁর ঢাকার বাড়িতেও র্যাব ঘুরে এসেছে। কিন্তু তিনি ওই ঘটনা জানার পর ভয়ে আত্মগোপন করেননি। পরদিনই তিনি নিজে র্যাবের দপ্তরে গিয়ে স্বেচ্ছা গ্রেপ্তারবরণ করেছেন!
সালাহউদ্দিন আহমদ শুধুই একজন রাজনীতিক নন। তিনি এই অঞ্চলের মানুষের দৃষ্টিতে গণমানুষের নেতা। আর নেতা বলেই কক্সবাজারে তাঁকে ভয় করে না এমন সন্ত্রাসি কিংবা পাতি নেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না! ‘ভয়’ কেন? তিনি কী তাদের নিজেই মারতে উদ্যত হন! না, কিন্তু তিনি যা পারেন অন্য নেতারা তা পারেন না! আর পারেন না বলেই রাজনৈতিক মহলে, প্রশাসনিক মহলে ‘সালাহউদ্দিন আতংক’ আছেই!
চেনা মুখ অচেনা আচরণ!
একজন মানুষ কখনোই সবাইকে খুশি করতে পারেন না। জীবনে চলার পথে কারো ভালো করতে পারেন, কিংবা ভালো করতে গিয়েই অন্য কারো জন্য তা খারাপ হয়ে যায়। সালাহউদ্দিন আহমদও একজন মানুষ, সবাই যে তাঁকে পছন্দ করেন এমন না! তাই তাঁর শক্রও কম সৃষ্টি হয়নি।
তিনি ‘নিখোঁজ’ হওয়ার পর জেলায় তাঁর চেনা-জানা মানুষগুলোও বিচিত্র আচরণ করেছেন! যে মানুষ গুলোকে সালাহউদ্দিন আহমদ নিজের খুব কাছের বলে জানতেন, সুস্থ হয়ে ফিরে আসার তিনি জানবেন ওই মানুষরা আসলেই তাঁর ছিলেন না!
সালাহউদ্দিন আহমদ ‘নিখোঁজ’ হওয়ার কয়েকমাস আগে কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে এক উম্মুক্ত মঞ্চে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি নির্দেশ দিতে নাও পারি, তাহলে তোমরা কক্সবাজার অচল করে দেবে!’ ওটা হয়তো তাঁর আবেগ ছিল। তাঁর সহকর্মীদের প্রতি অতিবিশ্বাস ছিল বলেই এই কথা তিনি বলেছিলেন! কিন্তু সালাহউদ্দিন ‘নিখোঁজ’ হওয়ার পর তাদের কেউ কেউ এমন আচরণ করেছেন যা কেউ আশা করেনি!
একদিকে সালাহউদ্দিন আহমদকে ‘সুস্থ ও অক্ষত’ অবস্থায় ফিরে পেতে আন্দোলন কর্মসূচি চলছে। অন্যদিকে চলছে নেতা-কর্মীদের ‘মন ভেঙ্গে’ দেয়ার মতো কাজ, ‘নাই, নাই, তাঁকে অনেক আগেই শেষ করে ফেলা হয়েছে!’
কেউ কেউ তো ওই সব ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে আছেন! সালাহউদ্দিন আহমদ হয়তো এই ‘বন্ধু’দের আরেকবার নতুন করে চিনতে পারবেন! তখন তিনি ভাববেন, আর কী করবেন!
আবার সালাহউদ্দিন আহমদের ‘খোঁজ’ মেলার পর সেইসব মানুষের আচরণে এসেছে হঠাৎই পরিবর্তন!
হায়, রাজনীতি এমন কেন!
সালাহউদ্দিনের সুস্থতা আর ফিরে আসা
দুইমাস দুইদিন সালাহউদ্দিন আহমদের খুব কাছের মানুষদের নিদারুণ কষ্টে কেটেছে। সাথে তাদেরও, যারা তাঁকে কখনো না দেখেই, কোনদিনও কথা বলা সুযোগ না পেয়েও তাঁর জন্য নির্জনে চোখের পানি ফেলেছেন!
১২ মে দুপুরে যখন ভারতের মেঘালয় থেকে সেই খবরটি এলো তখন হয়তো তাদের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে। মিটেছে কী মনের অশান্তি।
তাদের হয়তো তখনোই মনে প্রশান্তি আসবে যখন সালাহউদ্দিন আহমদ সুস্থ হয়ে আইনি জটিলতা কাটিয়ে আবারও নিজের জন্মভূমিতে ফিরে আসবেন।
যতটুকু জানা গেছে, ভারতীয় আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসতে হয়তো আরও বেশ কিছুদিন লাগতে পারে। সালাহউদ্দিন আহমদের স্ত্রী হাসিনা আহমদও ‘উদভ্রান্তে’র মতো দৌঁড়াচ্ছেন শিলং শহরে, কিভাবে তাঁর স্বামীকে সব আইনি বাধা কাটিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেন।
জেলাবাসি হয়তো সেইদিন শান্ত হবে যখন দেখবেন তাদের প্রিয় নেতা সুস্থ শরীরে কক্সবাজার বিমান বন্দরে নামছেন! শরীরে সেই চিরচেনা পোষাক। হাঁটায় সেই চিরচেনা ঢং। হাঁটতে হাঁটতে হয়তো হাত তুলে নাড়ছেন, ‘আমি এসেছি, আর কিসের ভয়!’
তেমনই একটি স্বপ্ন চোখে ভাসছে! একজন ‘আপনজনে’র জন্য মনের কোথায় যেন হু হু করছে!
নেতার জন্য আপামর মানুষের অপেক্ষা!
নেতা, আপনি কখন ফিরবেন?
লেখক ঃ আনছার হোসেন, নির্বাহী সম্পাদক ও বার্তা প্রধান, দৈনিক সৈকত। সভাপতি, অনলাইন রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (ওরাক) ও বাংলাদেশ অনলাইন জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশন, কক্সবাজার জেলা শাখা।
ই-মেইল : [email protected]
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।