নিয়তি কত নির্মম তা মানুষ কখনো আগে হতে জানতে পারে না। ঠিক যেমন বুঝতে পারেনি আমার বাবাও। প্রতিদিন ভাবত আজ পরিশ্রম করলে হয়তো কালকের দিনটি ভালো কাটবে, এবার নয় পরের পূজোয় হয়তো সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাবে।
গত ১২ জুন বাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকের ওয়ালে বাবাকে নিয়ে এমন আক্ষেপ করেছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মহেশখালী উপজেলার গোরকঘাটার মৃত স্বপন দাশের ছেলে সত্যপ্রিয় দাশ তপু। নিয়তি যে সত্যি নির্মম তা প্রমাণ করতেই কি না বাবার পথ ধরে না ফেরার দেশে চলে গেলেন সত্যপ্রিয়।
বাবার মৃত্যুর পর টিউশনি করে সংসার চালাত তপু। ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া শেষ করে পরিবারের হাল ধরা। ছোট ভাইকে পড়ালেখা শেখানো। নিজের পছন্দের প্রিয়জনকে বিয়ে করা। মা ও ভাইকে নিয়ে সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করা। কিন্তু কোনটিই হলো না তপুর। বাবার মৃত্যুর এক বছর ছয়দিন পর নিজেও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। শুধু রেখে গেলেন কিছু স্মৃতি। একটি দুর্ঘটনা কেড়ে নিল তার সব স্বপ্ন।
তপুকে হারিয়ে সবাই নির্বাক। মা শিলা দাশ বিলাপ করতে করতে বারবার মুর্চা যাচ্ছেন। তপুর সহপাঠী ও স্বজনরা তাকে সান্ত¡না দিচ্ছেন। কিন্তু কোনো সান্ত¡নাই যেন তার শোক ভুলাতে পারছে না। কলেজের সহপাঠীরা শোকে পাথর হয়ে গেছে। সবার চোখে মুখে একটিই প্রশ্ন। তপু তুই আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলি কেন?
ফেইসবুকে তপু সেদিন আরো লিখেছিলেন, জীবনে কষ্ট আসাটা স্বাভাবিক। কিন্তু সকল অপবাদ, শ্রম, ক্ষুধা ও দারিদ্রতাকে নিজের ললাটে ধারণ করে পরিবার তথা সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা কতটা কাঙ্খিত হতে পারে। তবে কি পিতা বলতে তাকেই বোঝায় যার কাছে নিজের খাবার অপেক্ষা ছেলেমেয়েদের টিফিন খরচ অধিক মূল্যবান। যার কাছে বছরে একটি নতুন কাপড় অপেক্ষা ছেলেদের মুখের হাসি অধিক মূল্যবান।
পরিবারকে নিয়ে একটি দিন ভালো কাটানোর জন্য সাগরের বুকে সহস্র নির্ঘুম রাত কাটানো আমার পিতা, সেই সাগরের বুকেই চির নিদ্রায় ঠাই করে নিতে হয়েছিল। এখনো অশ্রু জলে ভিজতে হয়, নিজের প্রতি প্রশ্ন জাগে। আমি কি পেরেছি আমার জীবনের একটা দিন বাবার প্রতি সমর্পন করতে? না পেরেছি বাবার একটা ঘন্টার কষ্টকে নিজের করে নিতে। শুধু ভগবানের কাছে এইটুকু প্রর্থনা করি তিনি যেন তোমায় স্বর্গে স্থান দেয়।
এদিকে ২০১৭ সালের শুরুতে পরিবারের সম্মতিতে বিয়ের কথা ছিল তপুর। পাত্রী একই কলেজের ইংরেজী চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। বাড়ি একই গ্রামে। তপুর সহপাঠী জিয়াউদ্দিন রিপন বলেন, ‘ইংরেজী বিভাগের ৪র্থ বর্ষের এক ছাত্রীর সঙ্গে তপুর ৬ বছরের সম্পর্ক ছিল। দুই পরিবারের সম্মতিতে ২০১৭ সালের শুরুতে তাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। ঘটনার পর মেয়েটি কিছুক্ষণ পর পর অজ্ঞান হয়ে পড়ছে। তার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনা সব শেষ করে দিল।’
রিপন বলেন, ‘মহেশখালী উপজেলার গোরকঘাটায় তপুদের গ্রামের বাড়ি। চট্টগ্রাম শুলকবহর রওশন বোর্ডিং এলাকায় একটি মেসে থাকতো সে। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তপু ছিলেন সবার বড়। কত স্বপ্নের অকাল মৃত্য হলে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হবে?’
তপুর মামা হারাধন দাশ বলেন, ‘গত বছরের ১৩ জুন পানিতে ডুবে তপুর বাবা মারা যান। টিউশনি করে সে নিজের ও পরিবারের খরচ চালাত। সত্যপ্রিয়র ছোট বোন চয়নিকা দাশের বিবাহ হয়েছে ও ছোট ভাই শিপু দাশ স্থানীয় বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণীতে পড়ছে।’
সিটি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সভাপতি আলেক্স আলীম বলেন, সত্যপ্রিয় খুব মেধাবী ও বিনয়ী ছাত্র ছিল। সে আমাদের বিভাগে প্রথম স্থানে ছিল। তৃতীয় বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষায় তার জিপিএ ছিল ৩ পয়েন্ট ৩৪।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়েছিল তপু। কিন্তু ক্যা¤পাসে যাওয়া আসা এবং টিউশনি করতে না পারার ভয়ে ২০১০ সালে সিটি কলেজে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয় সে। টিউশনি করে পুরো পরিবার চালাতো। তার মৃত্যুতে আজ সবাই স্তব্ধ।
প্রাইভেট পড়িয়ে মেসে ফিরে বন্ধুর সঙ্গে পড়তে বসবে বলে ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন সত্যপ্রিয় দাশ তপু। গত বৃহ¯পতিবার সকালে চট্টগ্রাম নগরীর একটি মেসের বাসিন্দা সহপাঠী অরবিন্দ ধরের সঙ্গে এই ছিল তপুর শেষ কথা। ওইদিন সকাল পৌনে নয়টার দিকে ট্রাকের ধাক্কায় ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করে সত্যপ্রিয় দাশ তপু। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে নগরীর অভয়মিত্র শ্মশানঘাটে ধর্মীয় মর্যাদায় তাকে দাহ করা হয়।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।