দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তে আরটি-পিসিআর প্রযুক্তির পরীক্ষায় ব্যবহৃত প্রতি সেট কিটের বেসরকারি বাজারমূল্য এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা। আর সরকার এত দিন ধরে সেই কিট কিনেছে দুই হাজার ৭০০ টাকা করে। অর্থাৎ প্রতি সেটে এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা বেশি ধরা হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকেই প্রতি সেট আরটি-পিসিআর কভিড-১৯ টেস্ট কিটের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল দুই হাজার ৭০০ টাকা করে। ওই দর অনুসারেই ১০টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান প্রায় ১৫ লাখ কিট বিদেশ থেকে আমদানির পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে হস্তান্তর করেছিল। প্রতি সেট কিট বাবদ এক হাজার ১০০ টাকা হিসাবেও অতিরিক্ত অর্থের অঙ্ক দাঁড়ায় ১৬৫ কোটি টাকা।
জানা গেছে, সরকার নির্ধারিত বাড়তি দরে আনা প্রায় সাত লাখ কিট এরই মধ্যে ব্যবহারও করা হয়েছে। এখন অতিরিক্ত দামের বিষয়টি ধরা পড়ার পর প্রতি সেট বাবদ ৫০০ টাকা কমিয়ে দুই হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর পরই বেঁকে বসে সরবরাহকারীরা। তৈরি হয় বিল নিয়ে জটিলতা। এতে বেশির ভাগ সরবরাহকারী কিট সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। পরিণতিতে দেখা দেয় কিটের সংকট।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্ব নেওয়ার পর অতিরিক্ত দামের বিষয়টি নজরে এলে তা কমিয়ে প্রতিটি দুই হাজার ৭০০ থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এতেও সরবরাহকারীদের ভালো অঙ্কের লাভ থাকার কথা।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কভিড-১৯ টেস্টের জন্য মোট চার ধরনের উপকরণ লাগে। তা নিয়ে একটি টেস্ট সেট। গড়ে বাজারদর এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা। তবে ওই সময় বড় ধরনের ক্রাইসিস চলছিল। তাই আমাদের তরফ থেকে দাম বেশি ধরার জন্য অধিদপ্তরকে অনুরোধ করা হয়। আমাদের কেউ কেউ ওই দাম তিন হাজারের বেশি ধরার জন্যও বলেছিল। একপর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে দুই হাজার ৭০০ টাকা নির্ধারণ করে দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষ কমিটি।’
বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. কামরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একেক দেশের কিটের দাম একেক রকম। তবে গড়ে প্রতি সেট কিটের দাম এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা ধরা যায়। যেমন চায়নিজ কিটের দাম আরো কম থাকে। আমরা ইউরোপের যে কিট আনি সেগুলো এক হাজার ৮০০ টাকা করে বিক্রি করি। তবে এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক খরচ ধরেই আমাদের বিল করতে হয়। ধরুন, যে প্রতিষ্ঠান এক লাখ কিট দিয়েছে তার বিল আসবে দুই হাজার ৭০০ টাকা দরে ২৭ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রতি কোটি টাকা বিল তুলতে ১৩ শতাংশ কর দিতে হয়। এর বাইরে আরো নানা খরচ তো থাকেই।’
কিট সরবরাহকারী আরেক বড় প্রতিষ্ঠান ওএমসির পরিচালক মারুফ মান্নান বলেন, ‘বাজারে ৫০০ কিংবা এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকায়ও একই কিট পাওয়া যায়। অন্য ব্যবসায়ীরা যে যার মতো দরে বিক্রি করে থাকতে পারে। তবে আমরা দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা দরে বিক্রি করি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, ওএমসি কম্পানির সরবরাহ করা কিট পুরোটাই চীন থেকে আনা। এর দাম এক হাজার ৪০০ টাকারও কম হওয়ার কথা। অথচ তারাই দাম ধরার জন্য তৎপরতা চালিয়েছিল এবং সরবরাহও করেছে সবচেয়ে বেশি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওএমসির পরিচালক বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘এসব ব্যাপারে আমি কিছু জানি না, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানে।’
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে গতকাল সোমবার পর্যন্ত মোট পরীক্ষা হয়েছে আট লাখ ৬০ হাজার ৩৬০টি। আরো কয়েক গুণ পরীক্ষার চাহিদা থাকলেও আরটি-পিসিআর পদ্ধতির পরীক্ষার কিট ও ল্যাবরেটরিজনিত নানা সংকটের কারণে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে প্রথম সংকট হিসেবে উঠে আসে পর্যাপ্ত কিট না থাকা। আবার কিট সরবরাহ না থাকার নেপথ্যে এই অতিরিক্ত বিলের পথ বন্ধ করে দেওয়ার প্রভাব রয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে।
বিলের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (অর্থ) মঞ্জুর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দাম নির্ধারণের সঙ্গে আমি জড়িত নই। এখন পর্যন্ত আরটি-পিসিআর কিটের কোনো বিল আমার কাছে আসেনি। কোনো বিল দেওয়াও হয়নি। বিল এলে তা যাচাই-বাছাই করে দেখা যেত।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।