দেশের সবগুলো জেলায় এখন মহামারি করোনার ছোবল পড়েছে। সর্বশেষ ৬৪তম জেলা হিসেবে বুধবার (৫ মে) পার্বত্য রাঙামাটিতে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এক শিশুসহ চারজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছেন। দেশে করোনা শনাক্তের ৬০তম দিনে শেষ জেলা হিসেবে রাঙামাটিতে হানা দিলো করোনাভাইরাস। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়।
অবশ্য সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর বুধবার (৬ মে) প্রকাশিত প্রতিবেদনে রাঙামাটিতে করোনা শনাক্তের বিষয়টি উল্লেখ নেই। আইইডিসিআর প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টার তথ্যের আলোকে প্রতিবেদন তৈরি করে। পরে দুপুরে বুলেটিনে তার সারসংক্ষেপ প্রকাশ করে এবং দিনের কোনও এক সময় প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। এ হিসেবে রাঙামাটির তথ্যটি যেহেতু বুধবার দিনের, ফলে এটি আইইডিসিআরের বৃহস্পতিবারের প্রতিবেদনে প্রকাশ পেতে পারে।
আইইডিসিআরের তালিকা মূলত প্রকাশের দিন আট ঘণ্টা (দিবাগত রাত ১২টা থেকে সকাল ৮টা) এবং আগের দিন ১৬ ঘণ্টার (সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা) তথ্য দেওয়া হয়। এতে করে আগের দিনের শনাক্ত রোগীই বেশি স্থান পায় ওই তালিকায়। অপরদিকে স্থানীয় প্রশাসন থেকে নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়ার পরপরই তা প্রকাশ করা হয়। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে আইইডিসিআরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা কোনও জেলার শনাক্তের সময় ও স্থানীয় প্রশাসনের দেওয়া সময়ের মধ্যে একদিন আগপিছ হয়ে থাকতে পারে।
আইইডিসিআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী বুধবার পর্যন্ত দেশে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১১ হাজার ৭৭৯ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৮৬ জন। এ সময়ে ৯৯ হাজার ৬৪৬ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছে ৭৯০ জন। প্রতিদিন গড়ে আক্রান্তর সংখ্যা বেড়েই চলছে।
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী করোনা পজিটিভের ৬৮ শতাংশ পুরুষ ও ৩২ শতাংশ নারী। বয়স ভিত্তিক আক্রান্তদের মধ্যে দশ বা তার চেয়ে কম বয়সের ৩ শতাংশ, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ৮ শতাংশ, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ২৬ শতাংশ (সর্বোচ্চ), ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ২৪ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ১৮ শতাংশ, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ১৩ শতাংশ এবং ৬০ বছরের বেশি ৮ শতাংশ।
করোনায় মৃতদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ পুরুষ এবং ২৭ শতাংশ নারী। মৃতদের মধ্যে দশ বছর বা তার কম বয়সের ২ শতাংশ, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে শূন্য শতাংশ, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ৩ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ৭ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ১৯ শতাংশ, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ২৭ শতাংশ এবং ৬০ বছরের বেশি ৪২ শতাংশ।
করোনা আক্রান্তের সংখ্যা সব থেকে বেশি রাজধানী ঢাকায়। ঢাকা মহানগরেই করোনা শনাক্ত হয়েছে পাঁচ হাজার ৬৭৪ জনের। ঢাকার পরেই রয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা। দেশের প্রথম করোনা আক্রান্ত এ জেলায় এ পর্যন্ত এক হাজার ৭২ জন শনাক্ত হয়েছে। অপর দিকে সব থেকে কম করোনা আক্রান্ত জেলা হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বাগেরহাট ও খাগড়াছড়িতে দুইজন করে করোনা পজিটিভ রোগী রয়েছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে শনাক্তের ১০দিনের মাথায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ই মার্চ। এদিকে ১৯শে মার্চ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য প্রথম লকডাউন ঘোষণা করা হয় মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা।
করোনা শনাক্তের শুরুর দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আক্রান্তদের তথ্য প্রকাশ করা হতো না। এমনকি তারা কোন এলাকার অধিবাসী সেই তথ্যও প্রকাশ করা হতো না। রোগীদের নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর এ গোপনীয়তা রক্ষা করে। করোনা শনাক্তের ১৫দিনের মাথায় ২৩ মার্চ আইইডিসিআর সর্বপ্রথম রোগীদের জেলার নাম জানায়। ওইদিন জানানো হয়, ৭ জেলার মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। সেই জেলাগুলো ছিল ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর, কুমিল্লা, গাইবান্ধা, চুয়াডাঙ্গা ও গাজীপুর।
অবশ্য এর মধ্যে কুমিল্লা জেলার তথ্যটি সঠিক ছিল না বলে জেলার সিভিল সার্জন জানিয়েছিলেন। ২৩ মার্চ কুমিল্লায় আক্রান্তের যে তথ্যটি দেয়া হয়েছিল সেটি ছিল মূলত ঢাকার ঘটনা। আক্রান্তের স্থায়ী ঠিকানা কুমিল্লা হওয়ায় আইইডিসিআরের তথ্যগত ওই ভুলটি হয়েছিল।
গত ৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জ ও মাদারীপুর জেলায় সর্বপ্রথম করোনা শনাক্ত হয়। এরপর ১৪ মার্চ রাজধানী ঢাকায় করোনা শনাক্ত হয়। এক জার্মান ফেরত যুবকের শরীরে করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়। ঢাকার পর ১৭ মার্চ গাজীপুরে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়।
চুয়াডাঙ্গায় প্রথম করা শনাক্ত হয় ১৯ মার্চ। ২২ মার্চ গাইবান্ধায় করোনা শনাক্ত হয়। কক্সবাজারে ২৪ মার্চ প্রথম করোনা পজিটিভ রোগী পাওয়া যায়। শরীয়তপুরে প্রথম শনাক্ত হয় ৪ এপ্রিল। অবশ্য ওই ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর করোনা পজিটিভের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। বগুড়ায় প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ৪ এপ্রিল।
গত ৫ এপ্রিল একইদিনে পাঁচটি জেলায় করোনা শনাক্ত হয়। জেলাগুলো হলো মানিকগঞ্জ, জামালপুর, সিলেট শেরপুর এবং মৌলভীবাজার। নরসিংদীতে প্রথম করোনা চিহ্নিত হয় ৬ এপ্রিল। কিশোরগঞ্জের করোনা সংক্রমণের তথ্য পাওয়া যায় ৭ এপ্রিল। একইদিনে টাঙ্গাইল, নীলফামারী ও কুমিল্লায় জেলায় করোনা পজিটিভ রোগী চিহ্নিত হয়।
বাংলাদেশে করোনা শনাক্তের একমাস পর গত ৮ এপ্রিল রংপুরে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। পরদিন ৯ এপ্রিল গোপালগঞ্জে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়।৯ এপ্রিল চাঁদপুর ও পটুয়াখালী জেলায়ও প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। গত ১০ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বরগুনায় করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়। এদের মধ্যে বরগুনার আক্রান্ত ব্যক্তিটির রিপোর্ট আসার আগেই মারা যান।
গত ১১ এপ্রিল একযোগ ৫টি জেলায় করোনাভাইরাস হানা দেয়। জেলাগুলো হলো-রাজবাড়ী, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, নোয়াখালী ও হবিগঞ্জ।
এরপরদিন ১২ এপ্রিল একইসঙ্গে আট জেলায় নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়। এদিন রাজশাহী, ফরিদপুর, ঝালকাঠি, খুলনা, যশোর, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল ও সুনামগঞ্জে করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়। পিরোজপুর, নড়াইল ও কুড়িগ্রামে প্রথম করোনা পজিটিভ হয় ১৩ এপ্রিল। দিনাজপুর ও জয়পুরহাটের প্রথম করোনা শনাক্ত হয় গত ১৪ এপ্রিল।
পার্বত্য জেলা বান্দরবানে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় ১৫ এপ্রিল। ফেনী, বাগেরহাট ও পাবনায় প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ১৬ এপ্রিল। দেশের উত্তর-পশ্চিমের সর্বশেষ জেলা পঞ্চগড়ে ১৭ এপ্রিল করোনা শনাক্ত হয়। ১৯ এপ্রিল সিরাজগঞ্জে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে জেলায় প্রথম করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয় ২০ এপ্রিল। মাগুরায় প্রথম শনাক্ত হয় ২১ এপ্রিল। মেহেরপুরে প্রথম করার শনাক্ত হয় ২২ এপ্রিল। ২২ এপ্রিল কুষ্টিয়াতেও প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। নওগাঁয় প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ২৩ এপ্রিল। একইদিনে দেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলায় প্রথমবারের মত দুইজন করোনা শনাক্ত হয়। ঝিনাইদহে ২৫ এপ্রিল করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। প্রথম শনাক্ত হওয়া দুইজনের একজন পুরুষ ও একজন নারী। তারা দুইজনই অন্য এলাকা থেকে এখানে আসে।
গত ২৬ এপ্রিল সাতক্ষীরায় করোনা শনাক্ত হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি সাতক্ষীরা বসবাস করলেও চাকুরি করেন যশোরের শার্শা উপজেলায় সেখানেই তিনি সংক্রমণ হন। অবশ্য সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন বলেছেন তাদের জেলায় প্রথম সংক্রমণ হয় ২৮ এপ্রিল। ২৮ এপ্রিল নাটোর জেলায় প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর ৫৩তম দিনে ২৯ এপ্রিল খাগড়াছড়ি জেলায় প্রথম করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। আর ৬০তম দিনে করোনা শনাক্ত হলো সর্বশেষ জেলা রাঙামাটিতে।
বাংলা ট্রিবিউনের রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি জানান, গত ২৯ এপ্রিল আক্রান্তদের নমুনা সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সাইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখান থেকে বুধবার (৬ মে) করোনা পজিটিভ হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। আক্রান্তদের মধ্যে একজন শহরের রিজার্ভ বাজার এলাকায়, দুইজন হাসপাতাল এলাকায় ও একজন দেবাশীষ নগরে বাস করেন। আক্রান্তদের মধ্যে একজন নার্স ও এক নয় মাসের শিশু রয়েছে। আক্রান্তদের সবাই রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।