রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় মারাত্মক চাপ পড়ছে। বিশেষ করে খাদ্য, স্বাস্থ্য ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থায় হুমকি তৈরি হয়েছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কারণে।
সরকার দীর্ঘ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করেছে। এখন সীমান্ত এলাকায় দালাল ধরে রোহিঙ্গা মা-বাবার সঙ্গে তাঁদের শিশুরাও বাংলাদেশে ঢুকছে। এতে ভবিষ্যতে নতুন করে পোলিও রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন। শঙ্কার কথা জানিয়ে পোলিওসহ সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি লিখেছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন।
কক্সবাজারের স্থানীয় লোকজন বলছে, উখিয়া-টেকনাফ এলাকায় অন্তত ছয় লাখ বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছে। এ ছাড়া বছরের পর বছর ধরে লাখ লাখ রোহিঙ্গা এসে অবস্থান নিয়েছে। নানা সময় মিয়ানমার সরকারের সহিংসতার মুখে বাংলাদেশে এসেছে রোহিঙ্গারা। তবে তাদের কারণে কক্সবাজার, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চলতি মাসেই অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে উখিয়া-টেকনাফের বাসিন্দারা মনে করছে। এ দুই উপজেলায় দুটি নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে আরো দুটি অনিবন্ধিত ক্যাম্প রয়েছে। বাংলাদেশে ঢুকে সেখানে প্রাথমিক আশ্রয় নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। পরে বিভিন্ন স্থানে তারা ছড়িয়ে পড়ছে।
বিষয়টি উঠে এসেছে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেনের লেখা চিঠিতেও। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের কাছে ফ্যাক্সযোগে ওই চিঠি পাঠানো হয়। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে মিয়ানমারের পাঁচ থেকে সাত হাজার নাগরিক সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক ফ্যাক্সযোগে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন, গত ৯ অক্টোবর কিছু দুষ্কৃতকারী মিয়ানমারের সীমান্ত বাহিনীর কয়েকটি ফাঁড়িতে অতর্কিত হামলা চালায়। এতে অস্ত্রশস্ত্র লুটসহ হতাহতের ঘটনা ঘটে। লুট করা অস্ত্র উদ্ধারের লক্ষ্যে মিয়ানমার সরকার ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছে। অভিযান শুরুর পর সীমান্তের ওপার থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি ও কোস্ট গার্ড টহল বাড়িয়েছে। গত দুই দিনে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি বলে বিজিবি জানিয়েছে। তার পরও বাংলাদেশে এ পর্যন্ত পাঁচ থেকে সাত হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর মূল স্রোতের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশিদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে পোলিও রোগের আশঙ্কাও বাড়ছে। স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে সেবা দিয়ে পোলিওসহ অন্য সংক্রামক ব্যাধি এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরীও। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সমস্যা এক দিনের নয়, এটি প্রায় ৪০ বছরের পুরনো সমস্যা। মিয়ানমার সরকার কিছু দিন পর পর জাতিগত সংকট সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পার করে দিচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে উখিয়া-টেকনাফে বাংলাদেশি নাগরিক আছে ছয় লাখ। আর এখন রোহিঙ্গাও হয়ে গেছে ছয় লাখ। আরো রোহিঙ্গা ঢুকলে পরিস্থিতির অবনতি হবে। তাই অচিরেই মিয়ানমারের নাগরিকদের সে দেশে ফিরিয়ে দিতে হবে। এখানে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না।’
রোহিঙ্গাদের অবৈধ বসতির কারণে কক্সবাজারের বনাঞ্চল দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (দক্ষিণ) উপবন সংরক্ষক মো. আলী কবির। তিনি বলেন, কক্সবাজারে এক লাখ ৯ হাজার ১১২ একর বন রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ একর বনে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা অবস্থান করছে। অবৈধ রোহিঙ্গাদের বনের এক স্থান থেকে উচ্ছেদ করা হলে তারা অন্য স্থানে গিয়ে বসত শুরু করছে। এতে আরো বেশি হারে গাছ কাটা পড়ছে। ১২ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারকে উচ্ছেদে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট সংকটের কারণে উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশি নাগরিক ও রোহিঙ্গারা মিলে ১৭ হাজার একর বনভূমি দখল করে ফেলেছে।
সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশকে অনেক কষ্টে পোলিওমুক্ত করেছে সরকার। এখন রোহিঙ্গা মা-বাবার সঙ্গে তাঁদের শিশুরাও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। মিয়ানমার পোলিওমুক্ত দেশ নয়। এসব অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা মা-বাবার সঙ্গে আসা তাঁদের শিশুদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফের পোলিও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি তো আছেই। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে সেবা দিয়ে পোলিওসহ অন্য ব্যাধির সংক্রমণ ঠেকানোর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। আর রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সরকারি পর্যায় থেকে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। কোনো নির্দেশনা এলে মাঠপর্যায়ে জেলা প্রশাসন তা বাস্তবায়ন করবে।
রোহিঙ্গারা মিশে যাচ্ছে মূল স্রোতে : বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের দৈহিক গড়ন প্রায় একই। ধর্মের পাশাপাশি চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষার সঙ্গেও রোহিঙ্গাদের ভাষার মিল আছে। ফলে অনুপ্রবেশের পর তাদের অনেকে দ্রুত সমাজের মূল স্রোতে মিশে যাচ্ছে।
বন বিভাগের হিসাবে টেকনাফ-উখিয়ায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত চারটি শিবিরে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা আছে। এর সঙ্গে চলতি মাসে আসা রোহিঙ্গারা যোগ হয়েছে।
তবে এ চারটি ক্যাম্প ছাড়াও পুরো কক্সবাজার, বান্দরবান ও চট্টগ্রামে রোহিঙ্গাদের অবস্থান আছে। রোহিঙ্গারা এ দেশে বিয়ে করছে এবং স্থানীয় সরকার পর্যায়ে অনিয়ম করে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নাগরিক সনদ বা জন্মসনদ নিচ্ছে। বাংলাদেশি সেজে পাসপোর্টও করে নিচ্ছে তারা। বাংলাদেশে মাছ ধরাসহ এমন কিছু পেশা রয়েছে যেগুলোতে বাংলাদেশি শ্রমিকের চেয়ে কম পারিশ্রমিকে রোহিঙ্গাদের পাওয়া যায়।
খাদ্য সমস্যা : কক্সবাজার দেশে খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলাগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটের কারণে খাদ্য উদ্বৃত্ত কমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আ ফ ম শাহরিয়ার। তিনি বলেন, জনপ্রতি ৪৫৩ গ্রাম চাল হিসাবে জেলার ২৪ লাখ মানুষের জন্য বছরে তিন লাখ ৫৩ হাজার টন খাদ্যশস্য প্রয়োজন হয়। এর সঙ্গে বাড়তি পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার জন্য বছরে অতিরিক্ত ৮৫ হাজার টন খাদ্যশস্যের প্রয়োজন মেটাতে হচ্ছে। কক্সবাজার জেলায় বছরে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় প্রায় চার লাখ পাঁচ হাজার টন। আর কক্সবাজারবাসী ও রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্যশস্যের প্রয়োজন পড়ে প্রায় চার লাখ ৩৮ হাজার টন। অবশিষ্ট ৩৩ হাজার টন খাদ্যশস্য অন্য জেলা থেকে এনে চাহিদা মেটাতে হয়।
আইনশৃঙ্খলা সমস্যা : কক্সবাজার দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র। কিন্তু প্রায়ই সেখানে দেখা যাচ্ছে খুন, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন ও প্রশাসন এসব ঘটনার বেশির ভাগের জন্য রোহিঙ্গাদেরই দায়ী করছে।
এ বিষয়ে জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মমতাজ আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য অন্যতম দায়ী অশিক্ষিত রোহিঙ্গারা। অল্প টাকায় ভাড়াটিয়া হিসেবে খুন, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তারা। কক্সবাজার আদালতে বিচারাধীন মামলার আসামিদের একটি বড় অংশই এসব রোহিঙ্গা।
কক্সবাজার সদর থানার ওসি মো. আসলাম হোসেন বলেন, রোহিঙ্গারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য বেশি দায়ী। সর্বশেষ গত রবিবার রাতে সদর উপজেলা গেটে একটি ওষুধ কম্পানির প্রতিনিধির কাছ থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকা ছিনতাই হয়। পরে ওই ঘটনায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে, যার মধ্যে দুজন রোহিঙ্গা।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।