পুলিশ মনে করে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় জঙ্গি হামলার ঘটনা এক সুতায় গাঁথা। চট্টগ্রাম থেকে গ্রেনেড, বোমা ও ভেস্ট বহন করে ঢাকায় নেওয়ার পথে কুমিল্লায় বোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটায় জঙ্গিরা। আর কুমিল্লায় গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রামের পটিয়া ও সীতাকুণ্ডে ‘জঙ্গি আস্তানার’ সন্ধান চলে। সীতাকুণ্ডে জঙ্গি হামলা ও জঙ্গিদের মৃত্যুর পর পর ঢাকায় র্যাবের ওপর জঙ্গি হামলার চেষ্টার ঘটনা ঘটে। তিন জেলায় জঙ্গিদের ব্যবহূত বোমা-বিস্ফোরকের ধরন এবং চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বোমা প্রেরণের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার পর তা বিশ্লেষণ করে পুলিশ এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে বলে জানিয়েছে।
অন্যদিকে পুলিশ জানিয়েছে, সীতাকুণ্ডের ছায়ানীড় নামের জঙ্গি আস্তানায় গতকাল রবিবার পুলিশ ফের অভিযান চালিয়ে আরো কিছু বোমা ও অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) নুরে আলম মিনা ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে সংক্ষিপ্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, ওই জঙ্গি আস্তানার দ্বিতীয় কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে ছোট-বড় আটটি বোমা ও এক ড্রাম হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উদ্ধার করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) বোমা ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা। আগের দিনের উদ্ধার হওয়া ৯টি বোমাসহ চতুর্থ দিন মোট ১৭টি বোমা নিষ্ক্রিয় করেছে নগর পুলিশের এ দল।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, গুলশান হামলার পর ঢাকা ও উত্তরাঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক অভিযান চালায়। এসব অভিযানের পর জঙ্গিরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের পুনরায় সংগঠিত করতে চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে বেছে নেয়। এ কারণে তারা চট্টগ্রামে তৈরি বোমা ঢাকায় নিয়ে নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল। এই তথ্য জানতে পারে পুলিশ। জানার পর পরিকল্পনা অনুযায়ী কুমিল্লায় ধরা পড়ে হাসান ও ইমতিয়াজ। ডিআইজি বলেন, ঢাকা কিংবা উত্তরাঞ্চলে জঙ্গিরা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই কারণেই তারা চট্টগ্রাম অঞ্চলকে নিরাপদ মনে করতে পারে। ঢাকায় জঙ্গিরা ধরেই নিয়েছিল, পুলিশ তাদের কাছে পৌঁছে যাবে, এ কারণে তড়িগড়ি করে তারা আক্রমণ চালিয়ে থাকতে পারে।
চট্টগ্রাম রেঞ্জে এক সপ্তাহের অভিযান শুরু : চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় জঙ্গি আস্তানা থাকার তথ্য পাওয়ার পর পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ১১টি জেলায় একযোগে ভাড়া বাসা শনাক্ত এবং ভাড়াটিয়াদের তথ্য যাচাইয়ের অভিযান শুরু করেছে রেঞ্জ পুলিশ। গতকাল রবিবার থেকে এ অভিযান শুরু হয়েছে। বিশেষ করে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আশপাশের এলাকাগুলোতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এই অভিযান শেষ করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম জানান, প্রতিটি থানায় একাধিক টিম একসঙ্গে মাঠে নামবে। যেসব থানা এলাকায় ভাড়া বাসা আছে, সেসব এলাকার জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে পুলিশ ভাড়া বাসায় যাবে। এই অভিযান গতকাল রবিবার থেকে শুরু হয়েছে বলে তিনি জানান।
জঙ্গিদের সমন্বয়ক মায়নুল : শফিকুল ইসলাম বলেন, কুমিল্লার চান্দিনা থেকে গ্রেপ্তারকৃত হাসানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মিরসরাই থানা পুলিশ পটিয়ার একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায়। জানা গেছে, সেখানে জঙ্গিদের সমন্বয়ক ছিল মায়নুল হোসেন মুছা। কিন্তু সেখানে পুলিশের অভিযানের আগেই মুছা সরে গিয়েছিল।
রাশেদ-হূদয় সংগঠিত করছিল সীতাকুণ্ড আস্তানার লোকদের : সাধন কুঠির গ্রেপ্তারকৃত দম্পতি রিমান্ডে থাকা জসিম ও রাজিয়ার বরাত দিয়ে বলেন, দুই আসামিকে কথিত রাশেদ ও হূদয়ের ছবি দেখানো হয়েছিল। তারা স্বীকার করেছে, এই দুজন তাদের বাসায় যেত। ছায়ানীড়ে অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন পরিচালনার পর জঙ্গিদের যে চারটি লাশ উদ্ধার হয়েছে, সেখানে দুটি লাশ ছিন্নভিন্ন অবস্থা। এগুলো শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। তবে বয়স ও শারীরিক অবয়ব দেখে প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে এগুলো রাশেদ-হূদয়ের লাশ। এই রাশেদ-হূদয়কে ঢাকার মিরপুর থেকে নিখোঁজ হওয়া রাফিদ-আয়াদ বলে ধারণা পুলিশের।
বিনাশ হয়েছে রাফিদ-আয়াদের দল! কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা জানিয়েছে, সাত-আটজনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে জঙ্গিরা আস্তানায় অবস্থান করে। তাদের মধ্যে সন্দেহভাজন রাফিদ-আয়াদের (সাংগঠনিক নাম রাশেদ-হূদয়) নিয়ন্ত্রিত দলটি বিনাশ হয়েছে বলে মনে করেছে পুলিশ। ডিআইজি বলেন, কুমিল্লায় হাসান-ইমতিয়াজ এবং সীতাকুণ্ডে জসিম ও রাজিয়া গ্রেপ্তার হওয়ায় চারজন পুলিশের হাতে চলে এসেছে। ছায়ানীড়ে মারা গেছে চার জঙ্গি। এখন কথিত সংগঠক মুছা, সাগরসহ অন্যদের ধরা গেলে চট্টগ্রাম অঞ্চল অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত হয়ে যাবে।
তিন লাশ শনাক্ত : ছায়ানীড়ের বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া এক নারী, এক পুরুষ ও শিশুর মরদেহ শনাক্ত হয়েছে। পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেন, নিহত জঙ্গি কামাল ও তার স্ত্রী জোবাইদা এবং শিশুর লাশ গ্রহণের জন্য তাদের বাবা-ভাই এসেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনি জানান, ছাড়ানীড়ে নিহত চার জঙ্গি ও এক শিশুর লাশ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে স্তূপ করে রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রামে আসতে পারেন রাফিদ-আয়াদের স্বজনরা : সীতাকুণ্ডের ছায়ানীড়ে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নিহত দুই জঙ্গির মরদেহ ঢাকার রাফিদ-আয়াদের বলে পুলিশ সন্দেহ করে। পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেন, ঢাকা থেকে রাফিদ-আয়াদের পরিবার মরদেহ দেখার জন্য চট্টগ্রামে আসতে পারে। তিনি বলেন, ‘তাদের শরীরের অবশিষ্টাংশগুলো দেখে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তবে বৃহস্পতিবার আমরা কিছু ছবি তুলেছি। আশা করি, স্বজনরা এগুলো দেখতে পারবে। ’
ছায়ানীড় ঘিরে এখনো আতঙ্ক: এদিকে সীতাকুণ্ড পৌরসভার চৌধুরীপাড়া (প্রেমতলা) এলাকার জঙ্গি আস্তানা ‘ছায়ানীড়’ নামের বাড়িটি ঘিরে এখনো আতঙ্ক কাটেনি। ঘটনার চতুর্থ দিনেও এলাকার লোকজন ও পথচারীদের মধ্যে দেখা গেছে এক ধরনের আতঙ্ক। গতকাল রবিবার দুপুর ১২টায় ছায়ানীড়ের সামনে দিয়ে বাড়ি ফিরছিল কয়েকজন স্কুলপড়ুয়া শিশু শিক্ষার্থী। তারাও এক পলক বাড়িটির দিকে তাকিয়েছিল। পৌরসভার চৌধুরীপাড়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিউল আলম চৌধুরী মুরাদ বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে এলাকার মানুষজনের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে। এ আতঙ্ক কাটতে সময় লাগবে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।