২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায় খুন হন ওই এলাকার বাসিন্দা শেখ জামিল। ঘটনার পরপরই তার ভগ্নিপতি মো. মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করেন। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে একই এলাকার শাহাদাত হোসেন নামের এক যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। মামলার তদন্ত শেষে তিন বছর পর ২০০৪ সালে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। ওই বছরের ১৪ মার্চ মামলাটির চার্জ গঠন করেন আদালত। ঘটনার পর প্রায় ১৩ বছর কেটে গেলেও অদ্যাবধি শেষ হয়নি মামলার বিচারকাজ। দশ বছরের বেশি সময় কারাভোগের পর বর্তমানে জামিনে আছেন শাহাদাত।
এ মামলার পুলিশের চার তদন্ত কর্মকর্তা অদ্যাবধি সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হননি। তাদের বিরুদ্ধে একাধিকবার সমন জারির পরও হাজির না হওয়ায় অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছেন আদালত। বিষয়টি পুলিশ সদর দফতরকেও অবহিত করা হয়েছে। এতেও কোনো সাড়া মেলেনি। বরং পরোয়ানা মাথায় নিয়েই নির্বিঘেœ যার যার কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করছেন ওই কর্মকর্তারা।
শুধু শেখ জামিলের মামলাই নয়, এমন কয়েক হাজার মামলার বিচারকাজ ‘পুলিশি সাক্ষী’র অভাবে ঝুলে আছে বছরের পর বছর।
এসব সাক্ষীর অনেকেই ইতিমধ্যে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৫ বছরে সাক্ষ্য না দেয়ায় সারা দেশে ৬ হাজার ৮৯২ পুলিশের বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন বিভিন্ন আদালত। এর মধ্যে ২ হাজার ৭১৫ জন হাজির হলে আদালত তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা তুলে নেয়া হয়। বর্তমানে সারা দেশে ৪ হাজার ১৭৭ পুলিশ সদস্যের (সাক্ষী) রিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা বহাল রয়েছে। ফলে বছরের পর বছর মামলার তারিখ দিয়ে চলেছেন আদালত। বিচারপ্রার্থীরা ঘুরে ফিরছেন আদালতের বারান্দায়।
সম্প্রতি জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বলেছেন, পুলিশ অপরাধীদের গ্রেফতার করতে যতটা পারদর্শী, সাক্ষী উপস্থিত করতে ততটা নয়। তাই সাক্ষীর অভাবে ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হচ্ছে। আদালত ওয়ারেন্ট ইস্যু করার পর পুলিশ অপরাধীদের গ্রেফতার করলেও সাক্ষী হাজির করতে না পারার কারণে মামলা আটকে থাকে। ফৌজদারি আইনের ১৭১(২) উপধারায় বলা আছে, সাক্ষী হাজির করা পুলিশের কাজ। নিন্ম আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সঠিক সময়ে মামলার সাক্ষী হাজির না হলে মামলা রিলিজ করে দেবেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল যুগান্তরকে বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানলাম। এ বিষয়ে শিগগির কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হবে। পুলিশি সাক্ষীর অভাবে মামলার বিচারকাজ আটকে থাকা কাক্সিক্ষত নয়।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিলের সময় পাবলিক সাক্ষীর নামসহ স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ থাকে। কোনো সাক্ষী হাজির না হলে আদালত তার (সাক্ষী) বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানায় নোটিশ জারি করেন। এর পরও হাজির না হলে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। কিন্তু সাক্ষী হিসেবে পুলিশ সদস্যদের শুধু নাম, পদবি, আইডি নম্বর ও সংশ্লিষ্ট থানার (ঘটনার সময়ের কর্মস্থল) নাম উল্লেখ করা হয়। স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ না থাকায় সংশ্লিষ্ট সাক্ষীর ওই সময়ের কর্মস্থল বরাবর গ্রেফতারি পরোয়ানার নোটিশ ইস্যু করা হয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যখন ওই নোটিশ থানায় আসে, তখন সংশ্লিষ্ট সাক্ষী (পুলিশ সদস্য) অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন। ফলে ওই গ্রেফতারি পরোয়ানার নোটিশ ফেরত পাঠানো হয়। পরে বিভিন্ন দফতর ঘুরে যখন সংশ্লিষ্ট সাক্ষীর (পুলিশ) হাতে ওই নোটিশ পৌঁছে, ততদিনে মামলার তারিখ পার হয়ে যায়। এভাবেই দিনের পর দিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার সাক্ষী (পুলিশ সদস্য) আদালতে হাজির হতে পারেন না। ফলে এসব মামলার ভবিষ্যৎ একরকম অনিশ্চিত বলে আশংকা সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, পুলিশি সাক্ষীর অভাবে একদিকে যেমন গুরুতর অপরাধের আসামিরা জামিনে মুক্ত হচ্ছেন। অপরদিকে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় অনেক আসামিরই বিনা বিচারে বছরের পর বছর কারাগারে কেটে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ঢাকার ১৪টি আদালতের পৃথক ২৬টি মামলায় মোট ৬৮ জন পুলিশি সাক্ষীর বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ১টি মামলায় ৫ জন পুলিশ সাক্ষী, ঢাকার দুই নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ১টি মামলায় ৩ জন, ঢাকার তিন নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ১টি মামলায় ৩ জন, ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন ১ মামলায় ৪ জন, ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন পৃথক ৩টি মামলায় ১০ জন, ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন ১টি মামলায় ৪ জন, ঢাকার সাত নম্বর মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন পৃথক ৪ মামলায় ৮ জন, ঢাকার আট নম্বর মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ১টি মামলায় ৪ জন, ঢাকার পাঁচ নম্বর মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন পৃথক ২টি মামলায় ৩ জন, ঢাকার তিন নম্বর বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন ১ মামলায় ২ জন, ঢাকার নয় নম্বর বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন পৃথক ২টি মামলায় ৫ জন, ঢাকার জননিরাপত্তা বিঘœকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন পৃথক ৩টি মামলায় ৭ জন, পরিবেশ আপিল আদালতে বিচারাধীন পৃথক ৩ মামলায় ৬ জন ও পরিবেশ আদালতে বিচারাধীন পৃথক ২ মামলায় ৪ জন পুলিশ সাক্ষীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আবদুল্লাহ আবু যুগান্তরকে বলেন, মামলা দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন থাকার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো গাফিলতি নেই, ব্যর্থতাও নেই। সাক্ষী আনার দায়িত্ব পুলিশের। আর প্রতিটি মামলায় পুলিশি সাক্ষী থাকে। সাধারণ সাক্ষীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় স্থান পরিবর্তন করায় তাদের আর নতুন ঠিকানা পাওয়া যায় না। ফলে তাদের সাক্ষ্য গ্রহণও অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। কিন্তু যারা আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য তাদের হয়তো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু তাদের সন্ধান পাওয়া অসম্ভব, তা নয়। পুলিশের নথিপত্রেই এসব তথ্য রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলেই তাদের বের করে সাক্ষ্য দেয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পুলিশের গাফিলতি রয়েছে। সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও বহু মামলায় পুলিশি সাক্ষীর অভাবে বিচারকাজ আটকে আছে।
জানতে চাইলে ঢাকার পরিবেশ আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর মো. ফিরোজুর রহমান (মন্টু) যুগান্তরকে বলেন, ‘সব মামলাই দ্রুত নিষ্পত্তি হোক- এটাই আমরা চাই। কিন্তু মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী আদালতে যখন সাক্ষ্য দিতে না আসেন, তখন এমন বিপত্তি (বিচারে দীর্ঘসূত্রতা) ঘটে। আমরা পাবলিক সাক্ষীর জন্য অপেক্ষা করি না, তবে পুলিশি সাক্ষীর জন্য অপেক্ষা করি। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশি সাক্ষীর প্রতি সমন বা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও এ সংক্রান্ত কোনো রিপোর্ট পাওয়া যায় না। পুলিশি সাক্ষীও হয় না, বিচারও আটকে থাকে।’
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বাস্তব অবস্থায় যেসব পুলিশ সদস্য আদালতে মামলার সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছেন না তাদের তালিকা পুরোপুরি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। কোন কোন মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিচ্ছে না তা দেখে জানাতে হবে। অনেক সময় তদন্তকারী কর্মকর্তারা ব্যস্ত থাকেন। তবে সাক্ষী হাজিরের ক্ষেত্রে আদালতের যে নির্দেশনা থাকে, সে নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্তকারী কর্মকর্তাদের আদালতে অবশ্যই সাক্ষ্য দিতে হবে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের যথাযথ সময়ে আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য প্রদানের নির্দেশনা দেয়া আছে। মামলার বিচারকাজ যেন ত্বরান্বিত হয় সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। পুলিশি সাক্ষীর অভাবে আটকে থাকা কয়েকটি মামলার তথ্য নিচে দেয়া হল-
নরসিংদীর কান্দাইলের বাসিন্দা ইব্রাহিম খলিলউল্লাহ। ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বাড্ডা থানায় বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে একটি মামলা হয়। এ মামলায় ২০০৮ সালের ১৬ জুন চার্জ (অভিযোগ) গঠন করেন আদালত। চার্জ গঠনের পর সাড়ে ৮ বছরের বেশি সময় পার হলেও অদ্যাবধি এ মামলায় কোনো সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির না হওয়ায় উত্তরা র্যাব-১-এর তৎকালীন এএসআই মো. হুবার রহমান, তদন্ত কর্মকর্তা বাড্ডা থানার এসআই ফসিহুর রহমান, সিআইডি উত্তরের এসআই আকবর হোসেন, সিআইডি ঢাকা জোনের এসআই আলমগীরের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। মামলাটি আট নম্বর মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন।
রাজধানীর কোতোয়ালি থানাধীন সিদ্দিকবাজারের বাসিন্দা মো. কবির। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন তিনি। কোতোয়ালি থানায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলাও হয়। এ মামলায় ২০০৭ সালের ২৪ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত। চার্জ গঠনের প্রায় ১০ বছর পার হতে চললেও এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিএমপির কোতোয়ালি থানার তৎকালীন এসআই আসলাম হোসেন ও এসআই সায়েদুর রহমানের বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। দীর্ঘ ১০ বছর কারাভোগের পর গত বছরের ১৫ মার্চ জামিনে মুক্ত হয়েছেন মো. কবির। মামলাটি সাত নম্বর মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন।
রাজধানীর লালবাগের বাসিন্দা মো. মনির হোসেন। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে তার বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা হয়। এ মামলায় ২০০৭ সালের ৭ নভেম্বর চার্জ গঠন করেন আদালত। এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা লালবাগ থানার তৎকালীন এসআই শরীফুল ইসলাম ও মামলার রেকর্ড অফিসার এসআই মো. দেলোয়ার হোসেন অদ্যাবধি সাক্ষ্য দেননি। মামলাটিও সাত নম্বর মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন।
এ ছাড়া আরেক মামলার নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, ভোলা জেলার কাইচা এলাকার বাসিন্দা সুমন। ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে তার বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা হয়। এ মামলায় ২০০৭ সালের ২৯ জুলাই চার্জ গঠন করেন আদালত। চার্জ গঠনের পর সাড়ে ৯ বছর পার হলেও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্লবী থানার তৎকালীন এসআই মো. ওমর আলী, আরেক তদন্তকারী কর্মকর্তা একই থানার এসআই আশ্রাফুজ্জামান, মামলা রেকর্ড অফিসার এসআই ইমরান হাসানের বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। মামলাটি ঢাকার নয় নম্বর বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।