সাংবিধানিক পদাধিকারীদের সবার উপরে রেখে এবং জেলা জজ ও সচিবদের মর্যাদা সমান করে রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম সংশোধনের চূড়ান্ত রায় প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স নিয়ে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল নিষ্পত্তি করে সাবেক প্রধান বিচারপতি মো মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারকের আপিল বিভাগ ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি এই রায় দিয়েছিল। হাই কোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (বিচার ও প্রশাসন) সাব্বির ফয়েজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বিচারকদের স্বাক্ষরের পর বৃহস্পতিবার ৬২ পৃষ্ঠার ওই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটেও সেটি দেওয়া হয়েছে।
রায়ে যা আছে : ১ সংবিধান যেহেতু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, সেহেতু রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমের শুরুতেই সাংবিধানিক পদাধিকারীদের গুরুত্ব অনুসারে রাখতে হবে।
২ জেলা জজ ও সমমর্যাদার বিচার বিভাগীয় সদস্যরা রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমের ২৪ নম্বর থেকে ১৬ নম্বরে সরকারের সচিবদের সমমর্যাদায় উন্নীত হবেন। জুডিশিয়াল সার্ভিসের সর্বোচ্চ পদ জেলা জজ। অন্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে সচিবরা রয়েছেন।
৩ অতিরিক্ত জেলা জজ ও সমমর্যাদার বিচার বিভাগীয় সদস্যদের অবস্থান হবে জেলা জজদের ঠিক পরেই, রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমের ১৭ নম্বরে।
রায়ে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম কেবল রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে। নীতি নির্ধারণী ক্ষেত্র বা অন্য কোনো কার্যক্রমে যেন এর ব্যবহার হয় না। ১৯৮৬ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মো আতাউর রহমান একটি রিট আবেদন করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় জেলা জজদের পদমর্যাদা সচিবদের নিচে দেখানো কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল দেয় হাই কোর্ট। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দেওয়া রায়ে আটটি নিন্দেশনা দেয়। সে অনুসারে নতুন তালিকা তৈরি করতে সরকারকে ৬০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আদালত তা মঞ্জুর করে রাষ্ট্রপক্ষকে আপিলের সুযোগ দেয়। নিষ্পত্তির পর ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি আপিল বিভাগের ওয়েবসাইটে বলা হয়, সংশোধন, পরিমার্জন ও পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করা হল। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হওয়ার পর অতিরিক্ত আ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা সাংবাদিকদের বলেন “হাই কোর্টের রায়টি মোডিফাই করে আপিল বিভাগের প্রকাশিত রায় দেওয়া হয়েছে।”
তিনি জানান, পূর্ণাঙ্গ রায়ে রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমে নতুন কয়েকটি বিষয় সংযোজন করা হয়েছে। একুশে ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত, বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্তদের ‘যথাযথ সম্মান’ দিতে বলা হয়েছে। “আরেকটা বিষয় বলা হয়েছে। যারা সাংবিধানিক পদাধিকারী, তাদেরকে যেন অগ্রাধিকার দেওয়া হয় অন্যান্য পদের উপরে।” প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের ওই রায়কে‘নীতির বাইরে’বলেছিলেন।
গতবছর জাতীয় সংসদে তিনি বলেছিলেন, বলেছিলেন,“নিজেরাই নিজেদের প্রমোশন দেওয়া সমীচীন নয়, সম্পূর্ণ এথিকসের বাইরে”।
প্রধানমন্ত্রী সেদিন বলেছিলেন, “এভাবে নিজের পক্ষে নিজেকে ঘোষণা কখনও কোনোদিন আদালতের রাযে দেওয়া যায় না। এরকম হলে যে যেখানে আছে, যার যার মতো করে সুযোগ নেবে, কোনো শৃঙ্খলাই থাকবে না।” রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগের এ রায়ের রিভিউ চাইবে কি না জানতে চাইলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “রায় পুরোপুরি পর্যালোচনা, যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে রিভিউয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলার শুনানি করেছিলেন আইনজীবী আব্দুর রব চৌধুরী। হাই কোর্টে রিট আবেদনকারী পক্ষে ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ ও মো আসাদুজ্জামান। আপিল বিভাগে রায়ের দিন আব্দুর রব চৌধুরী বলেছিলেন, “এই রায়ের ফলে প্রধান বিচারপতি ৪ নম্বর ক্রম থেকে এক ধাপ উঠে স্পিকারের ক্রমে যাচ্ছেন। আর জেলা জজরা যাচ্ছেন সচিবদের সমান স্তরে। অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল সচিবদের ওপরে যাবেন।”
প্রধান বিচারপতি, জেলা জজ ও অ্যাটর্নি জেনারেলের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর সঙ্গে একমত পোষণ করে রিট আবেদনকারীর আইনজীবী আসাদুজ্জামান সেদিন বলেছিলেন, আপিল বিভাগের বিচারকরা মন্ত্রীদের সঙ্গে থাকবেন। হাই কোর্টের বিচারকরা থাকবেন প্রতিমন্ত্রীদের সঙ্গে। অ্যাটর্নি জেনারেল সচিবদের ওপর, সাংসদরা তিন বাহিনীর প্রধান ও সচিবদের ওপরে থাকবেন। “অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলরা সচিবের ঘরে অবস্থান করবেন। জেলা জজরা প্রজাতন্ত্রে নিয়োজিত সর্বোচ্চ কর্মকর্তার পদমর্যাদার সঙ্গে যাবেন।”
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।