দেখে বোঝার উপায় নেই তাঁরা কারাগারে। পরনে হুডি সোয়েটার, কানে হেডফোন, টিভি দেখার জন্য পাশে বড় একটা মনিটর। দুজন মিলে ভিডিওকলে কথা বলছেন। দাবি করছেন, ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কিছুদিনের জন্য তাঁরা কারাগারে আছেন। বের হয়েই টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করবেন। এলাকার ভোটারদের কাছে দোয়াও চেয়েছেন তাঁরা।
ঢাকার কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারে এমন আয়েশি জীবন কক্সবাজারের টেকনাফের দুই সহোদর মনির আলম বাদশা ও রফিক আলমের। গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর বিমানবন্দর স্টেশনে দুই ব্যাগে ২৬ হাজার ৬৩৫টি ইয়াবাসহ তাঁরা গ্রেপ্তার হন। পরে কমলাপুর রেলওয়ে থানায় হওয়া মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তাঁরা। আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠান। মনির ও রফিকের মুঠোফোনে ভিডিওকলে কথা বলার ও ভোট চাওয়ার ভিডিও ফুটেজ আজকের পত্রিকার হাতে এসেছে।
ইয়াবা কারবারিরা কারাগারে বসে কীভাবে এমন আয়েশি জীবনযাপন আর মুঠোফোন ব্যবহার করছেন—সে বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ বলেন, ‘আসলে এমনটা তো হওয়ার কথা না।’ ভিডিও ফুটেজটি দেখার পর তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখছি।’
কারাগারে আসামিদের এমন সুযোগ-সুবিধার অভিযোগ নতুন নয়। শুধু সাধারণ বন্দীই না, কারাগারে থাকা জঙ্গিদের হাতেও পৌঁছে গেছে মুঠোফোন-ল্যাপটপ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে এমন অনিয়ম ঘটছে। বারবার নতুন করে ঢেলে সাজানোর কথা বললেও কারাগারে কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে না।
টেকনাফে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মনির ও রফিক এলাকায় ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তাঁদের বাড়ি টেকনাফ পৌরসভার ডেইলপাড়ার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। টেকনাফে ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় শীর্ষে থাকা শফিকুল ইসলাম তাঁদের বড় ভাই। তাঁদের এই মাদক ব্যবসার বিষয়ে টেকনাফ থানা-পুলিশের কাছেও অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় সূত্র বলেছে, একসময় রিকশার মেকানিক হিসেবে কাজ করতেন মনির-রফিকের বাবা আবদুল গফুর। কিন্তু সেই কাজ বাদ দিয়ে জড়িয়ে পড়েন ইয়াবা ব্যবসায়। এখন তাঁদের পরিবারের নেতৃত্বেই মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় বড় চালান দেশে ঢুকছে। টেকনাফকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসায় ১০–১৫ সদস্যের একটি সিন্ডিকেট চালাচ্ছেন তাঁরা। আদালতেও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এমনটা জানিয়েছেন মনির ও রফিক।
স্থানীয় সূত্র আরও বলেছে, নিজেদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করেই মনিরকে টেকনাফ পৌরসভার নির্বাচনে সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থী ঘোষণা করে মাঠে নামিয়েছিলেন তাঁর বাবা আবদুল গফুর। কিন্তু গত ২৮ অক্টোবর দুই ভাই ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হওয়ার পর এলাকায় হইচই পড়ে যায়। এরপর আবদুল গফুর নিজেই কাউন্সিলর প্রার্থী হতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।
দুই ছেলের গ্রেপ্তার ও পারিবারিক ইয়াবা ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চাইলে আবদুল গফুর মোবাইল ফোনের কল কেটে দেন। এরপর কয়েক দফায় চেষ্টা করলেও তিনি আর ফোন ধরেননি।
এদিকে, রেলওয়ে পুলিশের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আকবর আজকের পত্রিকাকে বলেন, এই দুই ভাই টেকনাফের শীর্ষ তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী। ২০১৮ সালের ২৬ মে চকরিয়া এলাকায় ১ হাজার ২০০টি ইয়াবাসহ মনির গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত তাঁরা। মাদক ব্যবসা করে আয় করেছেন শত কোটি টাকা। তদন্তে নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কারাগারে বসে ভিডিওকলে মনির ও রফিকের ভোট চাওয়ার বিষয়ে এই তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, ‘কারাগারে মোবাইল ফোন কীভাবে ব্যবহার করছে, সেটা কারা কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে।’
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, কারা কর্তৃপক্ষের উচিত যত দ্রুত সম্ভব একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা এবং আসামিদের কারা এসব সুবিধা দিচ্ছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া। তা না হলে এবার তো শুধু নির্বাচনের প্রচারণা করেছে, এরপর কারাগারে বসেই বড় বড় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ঘটনা ঘটবে।
সার্বিক বিষয়ে অতিরিক্ত আইজি প্রিজন কর্নেল আবরার হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা যেকোনো অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কারাগারে কোনো অসাধু রক্ষীর স্থান হবে না।’
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।