যতই দিন যাচ্ছে, ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৃণমূল সংগঠনগুলো। জেলা ও থানায় দলীয় কোন্দলে মারামারি, হানাহানি ও সংঘর্ষের ঘটনা এখন নিয়মিত। সম্প্রতি অন্তত ২০ জেলায় দলীয় কোন্দল গড়িয়েছে মারামারি-প্রাণহানির পর্যায়ে। এ কারণে তৃণমূলের সাংগঠনিক রাজনীতি অনেকটাই নাজুক হয়ে পড়েছে। তৃণমূলের এমন পরিস্থিতিতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা এতটাই শঙ্কিত যে, বিরোধপূর্ণ জেলাগুলোয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে তারা বৈঠকেও বসতে শুরু করেছেন। তবে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এসব ঘটনাকে কোন্দল বলতে নারাজ। তাদের দাবি, এসব ঘটনা ‘বড় পরিবারের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝি’। এগুলোটা ‘ঠাণ্ডা লড়াই মাত্র।
বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের তৃণমূল সংগঠনের মধ্যে চলা কোন্দলের মধ্যে সম্প্রতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের ঘটনা।
স্থানীয় সংসদ সদস্যকে এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না করা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। জেলার বিজয়নগরে নবনির্মিত উপজেলা প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্রের উদ্বোধনের পূর্ব-নির্ধারিত তারিখ ছিল ২৩ এপ্রিল। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হকের বিজয়নগর সফর কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয় আগেই। কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীকে আমন্ত্রণ না জানানোর অভিযোগ তুলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এই সফরের বিরোধিতা করে। তারা কর্মসূচি বর্জনের পাশাপাশি মন্ত্রীর সফর ঠেকাতে হরতালের ডাক দেয়। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।
আর চট্টগ্রামের আউটার স্টেডিয়ামে সুইমিংপুলের নির্মাণ কাজ বন্ধের দাবিতে ঘেরাও কর্মসূচি পালনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের ২৫ নেতাকর্মী।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির সুইমিংপুল নির্মাণের পক্ষে। অন্যদিকে, সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরীর অবস্থানের বিপক্ষে। জেলার দুই শীর্ষ নেতার বিরোধিতার জের ধরেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রক্ত ঝরেছে।
এছাড়া, আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কোন্দলে জর্জরিত সাংগঠনিক জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, খুলনা জেলা, রাজশাহী জেলা, নাটোর, নওগাঁ, বরিশাল মহানগর, ভোলা, পিরোজপুর, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র গত তিন বছরে রাজনৈতিক কোন্দল ও অন্যান্য ঘটনা নিয়ে হত্যাকাণ্ডের যে বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে তাতে দেখা যায়, ২০১৬ সালে রাজনৈতিক সংঘাতে দেশে ১৭৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। নিহতদের ৮৩ জন আওয়ামী লীগের। ২০১৫ সালে রাজনৈতিক সংঘাতে প্রাণ হারানো ১৫৩ জনের মধ্যে ৩৩ জন এবং ২০১৪ সালে নিহত ১৪৭ জনের মধ্যে ৩৪ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। তাদের বেশিরভাগই দলীয় কোন্দলে নিহত হয়েছেন বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
আগামী নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করতে তৃণমূলের এসব দ্বন্দ্ব, কোন্দল, বিবাদ-বিরোধ দূর করতে উদ্যোগ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। নির্বাচনের আগেই তৃণমূলের এই কোন্দল নিরসনে প্রতিটি জেলা-থানার নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। রবিবার থেকে শুরু হওয়া এই উদ্যোগে এরই মধ্যে তিন জেলার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষও করেছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নির্ব্চনের আগে দলীয় কোন্দল নিরসনে ধারাবাহিক বৈঠক করছি। আশা করি এ কোন্দল নিরসন করতে পারব।’
তবে কেন্দ্রের এ উদ্যোগকে আমলে নিচ্ছেন না তৃণমূলের নেতারা। শুধু তাই নয়, অনেক জেলার নেতারা স্থানীয় পর্যায়ে মারামারি-হানাহানি পর্যন্ত গড়ানো ঘটনাগুলোকে কোন্দল বলতেও রাজি নন। এসব ঘটনা তাদের কাছে ‘ঠাণ্ডা লড়াই’। তারা বলছেন, রাজনীতিতে এগুলো স্বাভাবিক ঘটনা, এগুলো থাকবেই।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুষ্টিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি সদর উদ্দিন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগে কোন্দল বা বিরোধ-টিরোধ নেই ভাই। বিভিন্ন জেলায় নেতাদের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই আছে। রাজনীতিতে এগুলো থাকবে।’
চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোলায়মান জোয়ার্দার সেলুন বলেন, ‘জেলায় কোন্দল নাই, তবে ঠাণ্ডা লড়াই আছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের জেলার নেতাদের সঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদকের বৈঠক হয়েছে। সেখানে সংগঠনকে আরও গতিশীল করার বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করেছি। কোন্দল নিয়ে কথা হয়নি।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আপনাদের চোখে যেগুলো কোন্দল, আমাদের দৃষ্টিতে সেগুলো রাজনীতি। আওয়ামী লীগে কোনও কোন্দল নেই। বড় পরিবাবে ভুল বোঝাবুঝি থাকে। এগুলো মিটেও যায়। এগুলোকে বড় করে দেখার কিছু নেই।’
বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান মজনু বলেন, ‘কোন্দল নয়, কোথাও কোথাও নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি আছে। তবে সংগঠনে সবাই ঐক্যবদ্ধ।’
লক্ষ্মীপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যতটা প্রচার হয়, তেমন কোন্দল আওয়ামী লীগে নেই। এগুলো হয়, আবার মিটেও যায়। দলের প্রয়োজনে সবাই আবার এক হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের প্রয়োজনে সবাই এক।’
সূত্র- বাংলাট্রিবিউন
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।