এ এইচ সেলিম উল্লাহঃ শত কড়াকড়ির পরও থামানো যাচ্ছেনা ঝুঁকি নিয়ে মিয়ানমার থেকে রাতের বেলায় নৌকায় পারাপার। এ কারণে রোধ করা যাচ্ছে না নৌকাডুবির ঘটনাও। ফলে বাড়ছে রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও পুরুষের লাশের মিছিল। সোমবার ভোররাতে রোহিঙ্গা বোঝাই আরো একটি নৌকা টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ উপকূলে এসে ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এতে সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১১ রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়াদের মাঝে ৬ নারী, ৫ শিশু। এ ঘটনায় জীবিত ২১ জনকে উদ্ধার করা হয়। ২৯ আগস্ট থেকে ১৬ অক্টোবর একমাস ১৯ দিনে রোহিঙ্গাবোঝাই ২৬টি নৌকাডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৮২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব সলিল সমাধি স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ জনগণকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছে।
রাখাইনে এখনো নিপীড়ন ও পাশবিকতা চলমান থাকায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে বলে উল্লেখ করেছেন জীবিত উদ্ধার হওয়ারা।
কোস্টগার্ড শাহপরীর দ্বীপ স্টেশন কমান্ডার লে. জাফর ইমাম শরীফ জানিয়েছেন, সোমবার সকাল ৮টার দিকে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিম পাড়া বেড়িবাধঁ ভাঙার কাছাকাছি সাগর থেকে প্রথমে ৮টি মরদেহ গুলো উদ্ধার করা হয়। পরে বেলা ১১টার দিকে আরো ৩টি মরদেহ ভেসে আসার খবর পেয়ে তা উদ্ধার করা হয়েছে।
জীবিত উদ্ধার রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, রাখাইনের নাইক্যংদিয়া থেকে ৫০-৬০ জন রোহিঙ্গাবোঝাই একটি নৌকা শাহপরীর দ্বীপে কাছাকাছি পৌছলে সোমবার ভোররাতে ঢেউয়ের তোড়ে ডুবে যায়। এতে কেউ সাতরিয়ে বা কেউ ঢেউয়ের ধাক্কায় তীরে চলে আসে। আর বাকি অনেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। খবর পেয়ে সকাল ৮ টার দিকে কোস্ট গার্ডের একটি দল স্থানীয়দের সহযোগিতায় সেখানে অভিযান চালিয়ে ২১ জন জীবিত ও প্রথমে আট জনের মরদেহ উদ্ধার করে।
জীবিত উদ্ধার রফিক আহমদ ও ছেনুয়ারা বেগম দম্পতি বলেন, মিয়ানমার সেনারা তাদের গ্রামে এখনও নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। কাউকে কোথাও বের হতে দিচ্ছে না। তাই নাওয়া-খাওয়া নিয়ে চরম বেকায়দায় রয়েছি শত শত গ্রামবাসী। আবার সামনে পেলে পুরুষদের ধরে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রয় ও খাবার পাওয়ার কথা শুনে প্রাণ বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে সন্তানসহ নৌকায় উঠি। রোববার রাতে মংডু গুদাম পাড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসার পথে সোমবার ভোরে শাহপরীর দ্বীপের কাছাকাছি পৌছে ঢেউয়ের তোড়ে নৌকাটি উল্টে যায়। নৌকায় প্রায় ৬৫ জনের মত রোহিঙ্গা ছিল। এদের মধ্যে অধিকাংশ নারী ও শিশু ছিল। তাদের সন্তানদের এখনও খুঁজে পাননি বলে জানান তারা।
শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়া ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুরুল আমিন বলেন, শুনেছি সোমবার ভোররাতে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা পশ্চিম উপকূলের সাগর হয়ে শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে ঢোকার সময় ডুবে যায়। নৌকাতে বেশির ভাগ শিশু ও নারী ছিল বলে জানিয়েছে জীবিত উদ্ধার হওয়ারা। সে হিসেবে এখনো ৩৪ যাত্রী নিখোঁজঁ রয়েছে।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি মাইন উদ্দিন খান বলেন, শাহপরীর দ্বীপের কাছাকাছি রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবির ঘটনায় ৬ নারী ৫ শিশুসহ ১১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিখোঁজদের সন্ধান চলছে।
ওসি আরো বলেন, এটি প্রতিনিয়ত বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরী করছে। আমরা চেষ্টা করি কোন নৌকা যেন এপার থেকে ওপারে গিয়ে কাউকে নিয়ে না আসে। এপারের নৌকা নামা রদ হলেও ওপারের নৌকার মাঝিরা এখনও ঝুঁকি নিচ্ছে। ফলে বার বার ঘটছে নৌকা ডুবির ঘটনা। আর সলিল সমাধি হচ্ছে নারী-শিশু-বৃদ্ধদের। ঢেউয়ের তোড়ে এসব মরদেহ তীরে ভেসে এলে স্থানীয় আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা তা দেখে ব্যথিত হচ্ছে। আর প্রাণ বাঁচতে পাড়ি দিয়ে এপারে লাশের মিছিলে স্বজনদের অভিভুক্ত করে আহাজারিতে ভারি করছে সৈকত তীরের পরিবেশ। এটি সবার জন্য বিব্রতকর।
অপর একটি সূত্র জানায়, গত শুক্রবার দিবাগত রাত এগারটার দিকে শাহপরীরদ্বীপের গোলারচর এলাকায় রোহিঙ্গা বোঝাই দুইটি নৌকা তীরে ভিড়ে। ওই দুই নৌকায় ১৯ জন পুরুষ, ১৭ মহিলা ও ২২ জন শিশু ছিল। আর নৌকাগুলো তীরে ভেড়ার সাথে সাথে বিজিবি নৌকা দুটির যাত্রি ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট ৯ মাঝিকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
সেসময় দায়িত্বপালনকারি বিজিবি কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, রোহিঙ্গারা ইয়াবা নিয়ে আসতে পারে তাই সবাইকে তল্লাশী করে সকালে ক্যাম্পে পাঠানো হবে। আর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রোহিঙ্গাদের আনায় নৌকা দুটি ভেঙ্গে ফেলা হবে।
পরের দিন তাই ঘটে। এরপরও থামছে না রোহিঙ্গাদের ঝুঁকিপূর্ণ পারাপার।
সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুর হোসেন জানান, গত ৮ অক্টোবর মধ্যরাতে শাহপরীর দ্বীপ গুলারচরে রোহিঙ্গাবোঝাই অপরএকটি নৌকা ডুবির ঘটনায় ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৩৮ মৃরদেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। হিসাব মতে- গত ২৯ আগস্ট থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গাবোঝাই ২৬টি নৌকাডুবির ঘটনায় ১৮২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে ১৮১ জন রোহিঙ্গা। অন্যজন বাংলাদেশি নৌকার মাঝি। রোহিঙ্গাদের লাশের মধ্যে ৯১ জন শিশু, ৬২ জন নারী ও ২৯ জন পুরুষ। উদ্ধার হওয়া স্থানে ক্ছাাকাছি কবরস্থানেই তাদের দাফন করা হয়েছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।