কক্সবাজার সময় ডেস্কঃরোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালালেও কাঙ্খিক্ষত সাড়া দিচ্ছে না মিয়ানমার। বিশ্ব সম্প্রদায়ের অব্যাহত চাপে মিয়ানমার আলোচনার প্রস্তাব দিলেও সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার নীতিতে অটুট আছে। দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির সঙ্গে এখনো কোনো পর্যায়ে যোগাযোগ করতে পারেনি বাংলাদেশ। গত রবিবার ভয়েস অব আমেরিকা (ভোয়া) বাংলা সার্ভিসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ব্যাপারে দেশটির নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে কথা হয়নি। এ অবস্থায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালে ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের তরফ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটি প্রস্তাবনা মিয়ানমারের কাছে দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ওই প্রস্তাবনা মিয়ানমারের নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হয়। নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্টেট কাউন্সেলর সু চির দপ্তরের পূর্ণমন্ত্রীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সে দিনই একটি আমন্ত্রণপত্র সু চির দপ্তরে পাঠানো হয়। সু চির দপ্তর সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে। চাপের মুখে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলতে ঢাকায় একটি প্রতিনিধি দল পাঠাতে চায় মিয়ানমার। যদিও এখনো সেই সফরের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি।
আজ নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বৈঠকে উপস্থিত থেকে বাংলাদেশ তার বক্তব্য পেশ করবে। জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী দূত এবং যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশের অবস্থান তুলে ধরে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন চাইবে। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো, যাদের ঢাকায় দূতাবাস আছে, সেসব দেশের রাষ্ট্রদূতদের ব্রিফিং করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এ ব্রিফিংয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে প্রত্যাবাসনে সহযোগিতা চাওয়া হয়। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, সুইডেন, ইতালি, মিসর এবং জাপানের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন।
ব্রিফ শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের প্রত্যাশাÑ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া সব রোহিঙ্গা নিরাপদে মিয়ানমারে ফেরত যাবে। আমরা চাই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের মূল উদ্দেশ্য রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো। এ জন্য আমরা সবার সঙ্গে আলোচনা করছি। নিরাপত্তা পরিষদে নির্ধারিত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া পাঁচ দফা প্রস্তাব জাতিসংঘে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি তুলে ধরবেন বলে আশা করছি। শেখ হাসিনার প্রস্তাবগুলো হলোÑ অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ; অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ; জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষাবলয় গড়ে তোলা; রাখাইন রাজ্য থেকে জোর করে বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ ও দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির দপ্তরের ইউনিয়নমন্ত্রী ইয়ো টিন্ট সোয়ের ঢাকা সফর সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিনি অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আসবেন। এখনো তারিখ চূড়ান্ত হয়নি। তিনি যদি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চান, তা হলে তার সফর একটু পিছিয়ে যেতে পারে। এবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা না হলে পরবর্তী সময়ে দেখা হতে পারে।
এর আগে গতকাল সকালে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার ই আও হুরির সঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বৈঠক হয়। বৈঠকের পর প্রতিমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। বাংলাদেশের বিষয়টি সেখানে তুলে ধরেছি। জাপানের ভাইস মিনিস্টার বলেন, এই সময়ে বাংলাদেশের পাশে থাকব।
এদিকে আজকের অনুষ্ঠিতব্য বিশেষ বৈঠকের আগে গত মঙ্গলবার রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরেকটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। বৈঠকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর নৃশংস নির্যাতন আর সহিংসতার নিন্দা জানানো হয়। মঙ্গলবারের ওই রুদ্ধদ্বার বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল আজকের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয় নিয়ে বৈঠকটি করতে যাচ্ছে, তার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা এবং উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। ওই বৈঠকে রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ব্রিফিং করবেন। বৈঠক সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদ কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি না দিলেও জাতিসংঘে নিযুক্ত ব্রিটিশ উপ-রাষ্ট্রদূত জনাথন অ্যালেন বলেন, রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ, রোহিঙ্গাদের অবিলম্বে মানবিক সাহায্য কার্যক্রম শুরু ও কফি আনান কমিশন রিপোর্টের বাস্তবায়নের ওপর জোর দিচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদ। নিরাপত্তা পরিষদকে মিয়ানমার সরকারের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠাতে হবে, বর্তমানে সেখানে যে সহিংসতা চলছে তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে হবে এবং আপাতত রাষ্ট্রবিহীন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নির্ধারণ হবে বলে মন্তব্য করেন অ্যালেন। ফরাসি রাষ্ট্রদূত ফ্রাঁসোয়া দেলাত্রে জানান, মঙ্গলবারের বৈঠকে তিনি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের পাশে থাকার মৌখিক সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে জোরালো কোনো ভূমিকা নিচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই ভোগ করছে। এটি আরও বেশকিছু দিন ভোগ করতে হবে। এখন নতুনভাবে আলোচনা শুরু করাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ আলোচনা যত তাড়াতাড়ি শুরু করা যায় তত দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হবে। এ জন্য প্রয়োজন দক্ষ কূটনীতি। কূটনীতির মাধ্যমেই এর সমাধান সম্ভব। এ অবস্থায় আলোচনার প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান করা যাবে। না হলে রোহিঙ্গাদের অবস্থান দীর্ঘ হতে পারে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) রেজাউল করিম বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান কূটনীতিকভাবে সমাধান করতে হবে। দক্ষ কূটনীতিই পারবে এর সমাধান করতে। এ ক্ষেত্রে যে সব দেশ মিয়ানমারকে সহযোগিতা করছে তাদের বোঝাতে হবে। সফল কূটনীতির মাধ্যমেই এটি সম্ভব। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। না হলে রোহিঙ্গা অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় স্বাভাবিক।
এদিকে সহিংসতার আগুনে পুড়ে যাওয়া রাখাইনের গ্রামগুলো অধিগ্রহণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে মিয়ানমার সরকার। পুড়ে যাওয়া গ্রামগুলো অধিগ্রহণের পর পুনঃউন্নয়নমূলক কর্মকা- পরিচালনা করা হবে। গতকাল বুধবার দেশটির এক মন্ত্রী এসব তথ্য জানিয়েছেন। মিয়ানমারের সরকারি দৈনিক গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
রাখাইনের দীর্ঘদিনের উত্তেজনা নিরসনে সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্পর্কিত একটি কমিটির প্রধান দেশটির এই মন্ত্রী। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, রাখাইনের পুনঃউন্নয়নমূলক কর্মকা- খুবই কার্যকর হবে। আইন অনুযায়ী সরকার সংঘাতপূর্ণ ও বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পুনঃউন্নয়ন তত্ত্বাবধায়ন করে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।