বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, সরকারের স্বায়ত্তশাসিত বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটির অধীনে সারাদেশের গ্রামীণ পর্যায়ে রয়েছে ৮০ টি পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি।
বিদ্যুৎ বিভাগের করা এক জরিপের পরিসংখ্যান বলছে- পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সেবা পেতে ৪০ শতাংশ গ্রাহককে ঘুষ দিতে হয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) মাঠপর্যায়ের তদন্তেও মিলেছে সেবা গ্রহীতাদের পদে পদে হয়রানি ও পল্লী বিদ্যুৎ কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতির চিত্র।
কক্সবাজার পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির আওতাভুক্ত উখিয়া জোনাল অফিস, যার গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। অনিয়ম- দুর্নীতির মডেলে পরিণত হয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের জরিপ ও তদন্তের সত্যতা জানান দিচ্ছে এই অফিস।
নতুন সংযোগ থেকে শুরু করে মিটার স্থাপন, বিদ্যুতের খুঁটি সরানো, ট্রান্সফরমার পরিবর্তন, সেচ মিটার সহ নানা সেবার ক্ষেত্রে গ্রাহকদের গুনতে হয় মোটা অংকের টাকা।
এছাড়াও কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের সাথে গোপনীয় চুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিশেষ সুবিধা প্রদান, বনবিভাগের জায়গায় অবৈধভাবে সংযোগ দিয়ে অনৈতিক লেনদেন, ভূতুড়ে বিলের মাধ্যমে গ্রাহকদের জোরপূর্বক টাকা দিতে বাধ্য করা, বকেয়া বিলের নামে সংযোগ বিচ্ছিন্নের অজুহাতে অর্থ আদায়ের অজুহাত ও উঠেছে সাম্প্রতিক সময়ে।
মরিচ্যার পাগলিরবিল এলাকার আসমা সিদ্দিকা (ছদ্মনাম) নিজের ভোগান্তির কথা জানাতে গিয়ে দালালের হুমকির কারণে নাম-পরিচয় প্রকাশে অপারগতা দেখিয়েছেন।
আসমার দাবী (রেকর্ড সংরক্ষিত) , নতুন সংযোগের জন্য দালালের মাধ্যমে ২৫ হাজার টাকা ঘুষ দাবী করেন পল্লী বিদ্যুতের ওয়ারিং ইন্সপেক্টর গোপাল। নতুন সংযোগই পাননি তিনি বরং বিষয়টি ঊর্ধ্বতনকে অভিযোগ করায় ভয়ভীতি দেখাচ্ছে কতিপয় দালাল, ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়।
সম্প্রতি, উখিয়ার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে অবৈধ সংযোগ দিতে গিয়ে বনবিভাগের হাতে আটক হয়েছিলো ৪ পল্লীবিদ্যুৎ কর্মী। রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও একই অবৈধ সংযোগ দিয়ে অর্থ লেনদেনের প্রমাণ মিলেছে।
লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খোরশেদ নামে এক তথাকথিত ইলেকট্রেশিয়ানের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকার মাধ্যমে অবৈধ সংযোগ নেন সেখানকার এক বাসিন্দা।
ওই বাসিন্দার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেন (রেকর্ড সংরক্ষিত)।
নিবন্ধিত ৭ ইলেকট্রিশিয়ান থাকলেও খোরশেদ, ইমাম, সালাউদ্দিন, জসিমের মতো প্রায় ৪০ জন ইলেকট্রিশিয়ান নামধারী একটি চক্র জড়িত এসব অপকর্মে, সিন্ডিকেট বানিয়ে যাদের নিয়ন্ত্রণ করেন ওয়ারিং ইন্সপেক্টর গোপাল৷
অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ থেকে বড় কমিশন দেয় দালালেরা, অভিযোগ আছে গোপাল নিজের অংশ রেখে ভাগ পৌঁছান ডিজিএম সহ অন্য কর্তাদের পকেটে।
এদিকে প্রচন্ড তাপদাহের কথা মাথায় রেখে রেকর্ড উৎপাদন করছে বিদ্যুৎ বিভাগ, তা স্বত্ত্বেও তীব্র লোডশেডিং এ বেহাল অবস্থা উখিয়ার সাধারণ মানুষের। পল্লীবিদ্যুৎ জানিয়েছে, ৩৫ মেগাওয়াট চাহিদা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১৩ মেগাওয়াট।
গ্রামীণ পর্যায়ে লোডশেডিং হলেও ইনানীর পর্যটক জোনে সরবরাহ করা হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, যার নেপথ্যের কারণ কর্পোরেট গ্রাহকদের কাছে বাড়তি সুবিধা নিয়ে বন্টন ও লোড ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অনিয়ম।
রাজাপালংয়ের বাসিন্দা মোহাম্মদ করিম বলেন, ” গরমে তীব্র কষ্ট পাচ্ছি, তার উপর বিদ্যুৎ থাকে না৷ কিন্তু ইনানীর হোটেলে ঠিকই বিদ্যুৎ আছে এসব আসলে পল্লীবিদ্যুতের গাফিলতির ফসল। ”
অভিযোগগুলোর ব্যাপারে জানতে চেয়ে কথা হয় ডিজিএম কাইজার নুরের সাথে। মুঠোফোনে তিনি গোপনীয় তথ্য দেওয়া যাবে না উল্লেখ করে ” অফিসের ভেতরের কথা আপনাকে বলবো কেন” বলে দাম্ভিক উক্তি করে ফোন বিচ্ছিন্ন করে দেন।
বছর পাঁচেক আগে মানিকগঞ্জ পল্লীবিদ্যুৎ সমিতিতে এজিএমের দায়িত্ব পালনকালে একটি দুর্নীতির অভিযোগে সেখানকার স্বীকৃত দালাল নুরুল আলমের সাথে কাইজারের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছিলো তদন্ত কমিটি, ফলশ্রুতিতে তাকে সেখান থেকে বদলি করা হয়।
গত ২৮ এপ্রিল কথিত দালাল সিন্ডিকেট নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে, সেদিনই পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির অফিসিয়াল ওয়াটসআ্যপ গ্রুপে পল্লীবিদ্যুৎ এর নামে খবর প্রকাশ করা হলে আইসিটি মামলার হুমকি দেন সালাউদ্দিন সিকদার নামে এক ব্যবহারকারী (স্ক্রিনশট সংযুক্ত) ।
এব্যাপারে মন্তব্যের জন্য ফোন দেওয়া হলে সালাউদ্দিন ব্যস্ততা দেখিয়ে কল বিচ্ছিন্ন করে দেন, এরপর বারবার কল দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সালাউদ্দিন সেই কথিত সিন্ডিকেটের প্রভাবশালী দালাল এবং এই নামে উখিয়া পল্লীবিদ্যুতে কোন কর্মকর্তা নেই বলে নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজার পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার মকবুল আলম।
তিনি বলেন, ” মাত্র ২০ দিন হলো আমি এখানে যোগ দিয়েছি। অভিযোগ পেলেই তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছি, আপনি যে বিষয়গুলো জানিয়ছেন সেগুলো যাচাই করা হবে। ”
কোন অনিয়ম – দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।