রাজধানীর মগবাজারের ডাক্তার গলির বাসিন্দা লাবনী সুলতানা গত কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। জ্বরের মাত্রা ১০৪ ডিগ্রি। একই সঙ্গে ডায়রিয়া, দুই পায়ের পাতা ও মুখ ফুলে যাওয়া, বমি হওয়া এবং কিছুই খেতে না পারার কারণে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। চিকিৎসকের পরামর্শে শুধু প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খেয়ে একটু সুস্থ হয়ে উঠলেও শারীরিক দুর্বলতা কিছুতেই কাটছে না। এর পর তার দুই সন্তান নুসাইবা এবং নুবাইদও জ্বরে আক্রান্ত হয়। চিকিৎসকরা জানান, রাজধানীতে এবার ঘরে ঘরে কেউ না কেউ জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে শুধু ঢাকায় নয়, দেশজুড়েই এবছর জ্বরের প্রকোপ বেশি।
কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত দেড় মাসে তাদের কাছে যত রোগী এসেছেন, তার ৯০ শতাংশ জ্বরে আক্রান্ত। যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড বলা যায়। মূলত আবহাওয়ার পরিবর্তন, তীব্র তাপদাহ, বাতাসে আদ্রতার পরিমাণ বেশি হওয়ায় মানুষ জ্বরে আক্রন্ত হচ্ছে। মে মাসের শুরু থেকেই চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, টাইফয়েডসহ ভাইরাস জ্বরাক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। বেশির ভাগ রোগীর জ্বরের স্থায়িত্ব সর্বোচ্চ সাত দিনের মতো হলেও হাত-পায়ের ব্যথা ১৪ দিন থেকে ২১ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হচ্ছে। কারও কারও ব্যথা আরও বেশি দিন থাকছে।
নাখালপাড়ার বাসিন্দা শ্রাবনী হালদার প্রথমে নিজে এবং পরে তার স্বামী ও শিশুকন্যা জ্বরে আক্রন্ত হন। শ্রাবনী বলেন, ‘জ্বরে কিছুই খেতে পারতাম না। যদিও চিকিৎসক বেশি করে পানি খেতে বলেছিলেন। বেশি পানি খাওয়ায় কিছুক্ষণ পর পর বমি হতো। মেয়েটাও জ্বরে ভুগছে। তার কষ্ট দেখে সহ্য করতে পারছি না।’
স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে জানা যায়, ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে মে ও জুন মাসে সম্ভাব্য চিকুনগুনিয়া রোগী হিসেবে ভর্তি রয়েছেন ৩৩ জন এবং ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩২২ জন। এছাড়া ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিদিন রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসছেন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) সূত্রে জানা যায়, গত এপ্রিল এবং মে মাসে ২৬৪টি নমুনার মধ্যে ১৯৬টি চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়। রাজধানীর কাঁঠালবাগান ও গ্রিনরোড এলাকায় চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি বলে জানায় আইইডিসিআর। পরে তারা আরও ২৩টি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে অভিহিত করে। এলাকাগুলো হলো- ধানমন্ডি-৯/এ, ধানমন্ডি-৩২, মধ্যবাড্ডা, গুলশান-১, বনানী, মগবাজার, নয়াটোলা, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, রামপুরা, তেজগাঁও, কড়াইল বস্তি, মিরপুর-১, পীরেরবাগ, কুড়িল, লালমাটিয়া, পল্লবী, উত্তরা-৪ ও ৯ নম্বর সেক্টর, মোহাম্মদপুর, মণিপুরিপাড়া, মিরপুর-১, রায়েরবাজার ও শ্যামলী।
আইইডিসিআর -এর পরিচালক অধ্যাপক মেহেরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘ঘরের কোথাও যেন পানি জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলেই আমরা এসব রোগ থেকে দূরে থাকতে পারবো।’
আবহাওয়ার পরিবর্তনকে দায়ী করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এবার তীব্র তাপদাহের কারণে বাতাসের আদ্রতা ছিল অত্যন্ত বেশি। তীব্র গরমের সঙ্গে ছিল মাঝে মাঝে হালকা বৃষ্টি। আবহাওয়ার এই তারতম্যই জনস্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলেছে। ফলে মানুষ ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে।’
এ সময় জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের প্রচুর পরিমাণ পানি, স্যালাইন, ডাবের পানি এবং জ্বরের জন্য কেবলমাত্র প্যারাসিটামল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ বলেন, ‘চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনও অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়াই ভালো। আর নিজে নিজে কোনও ওষুধই খাওয়া যাবে না। হাত-পায়ের জয়েন্টের ব্যথার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেতে হবে।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুর রহিম বলেন, ‘গত কয়েক বছরের তুলনায় এবছর জ্বরের সর্বোচ্চ রেকর্ড করা হয়েছে। ঢাকা শহরে রাস্তা খোড়াখুড়িতে বৃষ্টির পানি এবং স্যুয়ারেজ লাইনের পানি জমে মশার জন্ম হচ্ছে। এছাড়া আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে মানুষ জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে।’
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।