কক্সবাজার সময় ডেস্কঃ মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বিরামহীন স্রোত ধীরে ধীরে কমে আসছে। প্রথম দিকে প্রতিদিন গড়ে দশ থেকে ১২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। এখন এ সংখ্যা কমে গেছে। তবে কত আসছেন সে পরিসংখ্যান দিতে পারেননি সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা। এদিকে উখিয়া-টেকনাফে শরণার্থী ব্যবস্থাপনায়ও ফিরছে শৃঙ্খলা। রাস্তার দু’পাশে অবস্থান নেয়া ভাসমান শরণার্থীদের নির্দিষ্ট ক্যাম্পে সরিয়ে নেয়া শুরু হয়েছে। এজন্য চলছে মাইকিং। বাড়ানো হচ্ছে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কেন্দ্র। স্থাপন করা হচ্ছে নতুন নতুন চিকিৎসা ক্যাম্প। জেলা প্রশাসনের নির্ধারিত বিতরণ কেন্দ্রের মাধ্যমে টোকেন পদ্ধতিতে প্রদান করা হচ্ছে ত্রাণ। তবে পালিয়ে আসা অনেক রোহিঙ্গা এখনও অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হারিয়ে ফেলছেন স্বজন। বার্ধক্য ও অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন কেউ কেউ। শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও নতুন জায়গায় নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করছেন শরণার্থীরা। এখন ভুলে থাকতে চাইছেন পেছনে ফেলে আসা স্বজন ও সহায়-সম্পদ হারানোর কষ্টের ইতিহাস। আপাতত তাদের জন্য ‘খুশি’র খবর হচ্ছে- তারা এখনও বেঁচে আছেন। বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করছে। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী সোমবার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে গিয়ে ৮টি লঙ্গরখানা খোলার ঘোষণা দিয়েছেন। নিজ দেশ থেকে উচ্ছেদে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত কিংবা কোনো জটিল-কুটিল খেলার কোনো হিসাব-নিকাশ বোঝেন না তারা। এসব বোঝার চেষ্টাও নেই। শুধু দু’বেলা দু’মুঠো খেয়েপরে সন্তানদের নিয়ে জীবন ধারণ করাটাই তাদের একমাত্র চিন্তা।
সোমবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবির, পালংখালী শরণার্থী শিবির, বালুখালী শরণার্থী শিবিরসহ আশপাশ এলাকা ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এ চিত্র।
কমে এসেছে রোহিঙ্গা স্রোত : ২৪ আগস্ট মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও জ্বালাও-পোড়াও শুরুর পর দলে দলে রোহিঙ্গারা জিরো পয়েন্টে আশ্রয় নেন। প্রথম কয়েকদিন বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করলেও ৩১ আগস্ট থেকে সীমান্ত প্রায় উন্মুক্ত হয়ে যায়। বাংলাদেশে দলে দলে ঢুকতে শুরু করেন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। বিশষ করে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও উখিয়ার কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে স্রোতের মতো আসতে থাকেন রোহিঙ্গারা। নিজ দেশে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনী ও ‘মগ’দের নির্যাতন ও বর্বরতার করুণ কাহিনী শুনে বিশ্ববিবেক থমকে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ সরকারও মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেয় নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের প্রতি। বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে উখিয়া-টেকনাফে ঢুকে পড়েন ৪ লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা। সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রতি দিন গড়ে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার শরণার্থী প্রবেশ করেন। উখিয়ার পথে পথে ক্ষুধার্ত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া ও খাবারের আর্তি দেখে চোখের পানি ফেলেছেন মানুষ। একসঙ্গে এত মানুষের ভার নিতে গিয়ে হিমশিম খায় প্রশাসন। তাদের আশ্রয় প্রদান, খাদ্য ও ত্রাণের জোগান দেয়া কিংবা স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে পড়তে হয় বিপাকে। ত্রাণ বিতরণে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা। তবে গত দু’দিন থেকে উখিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা প্রবেশের হার অনেকটা কমে গেছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের বিভিন্ন সূত্র ও সীমান্তবর্তী লোকজন। বিশেষ করে উখিয়ার হাতিমোড়া, ডেইলপাড়া, ঘুমধুম, বাইশফাঁড়ি, আচারতলী, চাকমা পাড়া, রেজু আমতলী, থাইংখালী, রহমত বিল সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা প্রবেশ অন্তত অর্ধেকে নেমে এসেছে।
সূত্র জানিয়েছে, অন্যদিকে মিয়ানমারের মংডু শহরের কাছের বেশ কয়েকটি গ্রামে সেনাবাহিনী এসে রোহিঙ্গাদের ওপর আর অত্যাচার করবে না বলে আশ্বস্ত করছে। ভালোভাবে চললে, কোনো ধরনের ঝামেলা না করে শান্তিপূর্ণ বসবাস করলে এবং ‘বিদ্রোহী’দের ব্যাপারে তথ্য দিলে তাদের পালিয়ে যেতে হবে না বলে জানায়। মংডু শহরের কাছে সুজাপাড়ার বাসিন্দা এক রোহিঙ্গার সঙ্গে সোর্সের মাধ্যমে কথা হয় যুগান্তরের। আবদুর রশীদ নামে ওই রোহিঙ্গা সোমবার জানান, ওই এলাকার আড়াইশ’ গ্রামে দুই থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। গণহত্যা শুরুর আগে এসব গ্রামে বসবাসরত বৌদ্ধদের সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরে রোহিঙ্গাদের হাট-বাজারে যাওয়া বন্ধ করে রেখেছিল সেনাবাহিনী। তবে দু-এক দিন থেকে গ্রামে মিলিটারি এসে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে। ‘বিদ্রোহীদের’ বিষয়ে তথ্য দিলে এবং কোনো ধরনের ঝামেলা না করলে তাদের ওপর হামলা এবং তাদের পালাতে হবে না বলে আশ্বস্ত করছে। এ কারণেও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা স্রোত কিছুটা কমেছে বলে জানান আবদুর রশীদ। তবে আতঙ্ক এখনও কাটছে না বলেও জানান ওই রোহিঙ্গা। উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাঈনুদ্দিন যুগান্তরকে জানান, সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা প্রবেশের হার অনেকাংশে কমে এসেছে। ত্রাণ বিতরণ, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট ক্যাম্পে পাঠানোর ক্ষেত্রেও শৃঙ্খলা ফিরে আসছে বলে জানান তিনি।
সরিয়ে নেয়া হচ্ছে নির্দিষ্ট ক্যাম্পে : সকালে উখিয়া-টেকনাফ সড়কের কুতুপালং এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, টমটমে করে মাইকিং চলছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের স্থানীয় ভাষায় মাইকিং করে বলা হচ্ছে যাতে তারা তাদের জন্য প্রদত্ত জায়গা উখিয়ার বালুখালী, কুতুপালং ও পালংখালী নতুন জায়গায় চলে যান। সেখানে সরকার তাদের জন্য নির্দিষ্ট ক্যাম্প করছে। নির্মাণ করা হচ্ছে শেড। রাস্তার দু’পাশ থেকে সরে যেতে বলা হচ্ছে। এরপরও যাদের পাওয়া যাবে তাদের জরিমানা করা হবে। সকালে কুতুপালং এলাকায় মূল রাস্তার সঙ্গে লাগোয়া পশ্চিম পাশের পাহাড়ে গিয়ে দেখা গেছে, বাঁশের কঞ্চি ও পলিথিন দিয়ে তৈরি করা সব ঘর ভেঙে দিয়েছে পুলিশ। বাঁশ-কাঠ, প্রাপ্ত চাল-ডাল, হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে বসবাসরত ভাসমান রোহিঙ্গারা ছুটছেন নতুন শিবিরে। তবে রাস্তার পাশের আলোকিত জায়গা থেকে দূরের পাহাড়ে বা জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় যেতে কষ্ট লাগছে তাদের। এমন কষ্টের কথা জানালেন কয়েকজন। মংডুর দক্ষিণে কুল্লুং থেকে আসা ছমুদা খাতুন (৪০) বসে আছেন হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে। ১০ ছেলেমেয়ে তার। নুরবাহার (৪০), ছুরুত জন (৬০)সহ একই পাড়া থেকে তারা ৫০-৬০ জন এসেছিলেন। একই পাহাড়ে অস্থায়ী ঘর করে শুরু করেছিলেন ভাসমান সংসার। ছমুদা খাতুন বলেন, ঠ্যাংখালী ও বালুখালীতে নাকি জায়গা নেই। তাদের ঘর ভেঙে দেয়া হয়েছে। নতুন ক্যাম্পে যেতে বলা হয়েছে। তার স্বামী আবু বক্কর নতুন শিবিরে জায়গা দেখতে গেছেন। এ একটি পাহাড়েই শতাধিক পরিবার ছিল। সবাই বাক্সপেটরা নিয়ে একেএকে বিলের আল ও পাহাড়ি পথ বেয়ে সরকার নির্ধারিত নতুন ক্যাম্পে বালুখালীর পাহাড়ি এলাকায় যেতে থাকেন।
শাশুড়িকে হারিয়ে বুক চাপড়ে কাঁদছেন রাহেনা : একই এলাকা থেকে নতুন ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য ৭০ বছরের শাশুড়ি রওশন জনকে নিয়ে রাস্তা পার হন রাহেনা (৩৫)। কিন্তু কিছু দূর না যেতেই তার হাতছাড়া হয়ে যান শাশুড়ি। তাকে দেখা গেল বুক চাপড়ে কাঁদতে। ‘আঁর অরিওয়া তোয়াই ন পাই। আরাই গেইয়গই।’ অর্থাৎ আমার শাশুড়ি কোথায় হারিয়ে গেছে। খুঁজে পাচ্ছি না। তাকে এদিক-সেদিক শাশুড়ির খোঁজে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। খাটিয়া নিয়ে লাশ নিতে দেখা গেল কয়েকজনকে। জানতে চাইলে খাটিয়া বহনকারী একজন বললেন, নুর মোহাম্মদ নামে (৭০) বছর বয়সী এক বৃদ্ধ মারা গেছেন। তিনিও রোহিঙ্গা। পালিয়ে আসার ধকল সইতে না পেরে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন তিনি। তাকে কবর দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পাহাড়ের পাদদেশে।
বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতা বাড়ানো হচ্ছে : বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের আওতা বাড়ানো হচ্ছে। কুতুপালং এলাকায় স্থাপিত নিবন্ধন বুথের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর আবেদ যুগান্তরকে জানান, নিবন্ধন শুরু হওয়ার পর থেকে সোমবার পর্যন্ত ১০টি বুথে তারা ৫ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন। নিবন্ধন দ্রুত করতে বুথের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে প্রতিদিনই। কয়েকদিনের মধ্যেই ৩০-৪০টি বুথ হবে। নিবন্ধন কার্যক্রম দ্রুত হবে। সোমবার একদিনেই ওই বুথে এক হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন করা হয়েছে বলে জানালেন তিনি। যেভাবে চলছে সেভাবে নিবন্ধন চললে আশ্রিত কয়েক লাখ রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন হতে কয়েক বছর লেগে যাবে এমন ধারণা প্রসঙ্গে এ কর্মকর্তা বলেন, দেড় বছরে যদি দেশের সব ভোটারের নিবন্ধন সম্পন্ন করা যায় তবে ৪-৫ লাখ রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন কেন দ্রুত করা যাবে না। নিবন্ধন করে বের হওয়া এক যুবকের কার্ড নিয়ে দেখা গেছে, কার্ডে নিজের নাম, পিতা-মাতার নাম, নিবন্ধনের তারিখ, মিয়ানমারের নাগরিকত্ব, জন্ম তারিখের উল্লেখ আছে। টোকেন দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন করা হচ্ছে।
এমএসএফের নতুন চিকিৎসা কেন্দ্র : কুতুপালং এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, নতুন করে অস্থায়ী একটি ট্রিটমেন্ট সেন্টার বা চিকিৎসা কেন্দ্র খুলছে এমএসএফ হল্যান্ড নামের একটি বিদেশি সংস্থা। তাদের স্থায়ী ক্যাম্প রয়েছে। ওই ক্যাম্পে রোগীর চাপ থাকায় নতুন চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছে। এ সংস্থা বিনা পয়সায় রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। এ ক্যাম্পের কো-অর্ডিনেটর জানান, রোহিঙ্গাদের চাপা বাড়ার কারণে তারা নতুন করে স্বাস্থ্য কেন্দ্র নির্মাণ করছে। যেখানে প্রয়োজন হবে সেখানেই অস্থায়ী স্বাস্থ্য কেন্দ্র নির্মাণ করে চিকিৎসা দেবে এমএসএফ হল্যান্ড।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।