প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার লাগোয়া উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়িতে ইয়াবা ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মরণ নেশা ইয়াবার ভয়ষ্কর বিস্তার হওয়ার কারনে এসব এলাকা থেকে ইয়াবা পাচারের কদর বেড়েছে। ইতিপূর্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় তাদের প্ররোচনায় আরো নতুন নতুন ইয়াবা ব্যবসায়ী সৃষ্টি হয়েছে। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে নারী পাচারকারীও। এ নিয়ে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ও পুলিশ প্রশাসনও রয়েছে বেকায়দায়। মাঝে মধ্যে ইনফরমেশন ভিত্তিতে অভিযান চালিয়েও ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ভিতরের-বাহিরের কিছু সদস্যদের আগাম তথ্য ফাঁসের কারনে এমনটি হতে পারে বলে ধারনা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র মতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা-৬ এর ২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বরের এক স্মারকপত্র সূত্রে মাদকদ্রব্য অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) প্রণব কুমার নিয়োগী স্বাক্ষরিত গত ২৩ জানুয়ারি একটি বিশেষ প্রতিবেদনে স্থান পাওয়া ৭৬৪ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় বান্দরবানের ২৯ জনের নাম পাওয়া গেছে। যার মধ্যে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার রয়েছে ২১জনের নাম। এখানে নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের ৯ জন, সোনাইছড়ি ইউনিয়নের ২জন, ঘুমধুম ইউনিয়নের ১০ জন। গত দুই বছর আগের এই তালিকার সাথে বর্তমানে যোগ হয়ে এ সংখ্যা দাড়িয়েছে উপজেলায় শতাধিক ইয়াবা পাচারকারীর নাম।
বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, মায়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের বানিজ্য কেন্দ্র টেকনাফ ইতিপূর্বে ইয়াবার স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিতি হয়ে উঠলেও সাম্প্রতিক অভিযানের কারণে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা রুট পরিবর্তন করেছে। টেকনাফে ব্যাপক আকারে ধড়পাকড় চললে বর্তমানে এ স্থানের পরিবর্তে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অন্যতম রুট হলো বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি। এ স্থান দিয়ে আগে উল্লেখযোগ্য হারে ইয়াবা আসেনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই রুটটি ব্যবহার করা হচ্ছে ইয়াবা পাচারের জন্য। গত দুই বছর ধরে নাইক্ষ্যংছড়ি হয়ে ইয়াবা ব্যবসা হলেও সম্প্রতি সময়ে ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যাও বেড়েছে কয়েক গুন। যার মধ্যে রয়েছে চাকরীজীবি, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ।
আর এ সুযোগে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা রমরমা বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। টেকনাফের মত এখানে নেই যত্রতত্র অভিযান, টহল, তল্লাসী এমনকি চেকপোষ্টও। এই ধারাবাহিকতায় নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার চাকঢালা, আশারতলী, সোনাইছড়ি, দোছড়ি, ঘুমধুম ও তুমব্রু সড়ক ব্যবহার শুরু করে ইয়াবা পাচারকারীরা।
স্থানীয়দের তথ্য মতে জানা যায়, মায়ানমার থেকে পার হয়ে সীমান্ত ঘেষা এলাকার নারী-পুরুষের সহযোগিতা নেন পাচারকারীরা। এরপর বিশেষ করে মোটর সাইকেল, সিএনজি, মাইক্রোবাস, চাদের গাড়ি, রিক্সা এমনকি কাঠ বোঝাই ট্রাকে যাত্রী ও কর্মজীবি সেজে এসব ইয়াবা পাচার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশল ও সড়ক পরিবর্তন করে থাকে। যেমন- চাকঢালা, আশারতলী সীমান্ত থেকে আসা ইয়াবা নাইক্ষ্যংছড়ির কলেজ রোড়, রেষ্ট হাউজ রোড়, সোনাইছড়ি রোড়, রূপনগর রোড় ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে রামু উপজেলার মৌলভীরকাটা, কচ্ছপিয়া-গর্জনিয়া ও শাহ সুজা সড়ক হয়ে পাচার হয়। সীমান্তের নিকুছড়ি থেকে আসা ইয়াবা আমতলীমাঠ, চাকঢালাসহ সোনাইছড়ি-ভগবান টিলা ও মরিচ্যা হয়ে পাচার হয়। দোছড়ি থেকে প্রবেশ হয়ে আসা ইয়াবা তিতারপাড়া-কচ্ছপিয়া বাইশারী রোড় ও নাইক্ষ্যংছড়ি প্রধান সড়ক দিয়ে পাচার এবং ঘুমধুম-তুমব্রু থেকে প্রবেশ হওয়া ইয়াবা প্রধান সড়ক ছাড়াও গ্রামের সুরু পথ হয়ে পাচার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
এসব পয়েন্ট হয়ে আসা ইয়াবা চাকঢালা বাজার, আশারতলী ব্রিজ, চেরারমাঠ, নাইক্ষ্যংছড়ি থানা মোড়, উপজেলা পরিষদ চত্বর, সোনাইছড়ি বটতলী, নাইক্ষ্যংছড়ি মসজিদঘোনা, বিছামারা, রূপনগর, জারুলিয়াছিড়, কচ্ছপিয়ার তুলাতলী স্টিল ব্রিজ, সিকদারপাড়া-শাহসুজা সড়ক, মৌলভীরকাটা, তিতারপাড়া, রামুর বাইপাস, রাবার বাগান এলাকা থেকে ইয়াবা বন্টন করে থাকে। উল্লেখিত এলাকা থেকে পরিবহন যোগে ইয়াবা পাচারের সময় একাধিক মোটর সাইকেল, সিএনজির মাধ্যমে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করে পাচারকারীদের নিকট মোবাইল ফোনে আগাম সংবাদ পৌছে দেয়। এ কাজে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু ব্যাক্তিসহ বিভিন্ন চেকপোষ্টের কর্মচারী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স, কিছু ব্যবসায়ীর নাম জড়িয়ে পড়েছে সম্প্রতি সময়ে।
উল্লেখিত এলাকা থেকে ইয়াবা বন্টন হওয়ার পর ইয়াবার বড় চালান এলাকা ভিত্তিক দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য চট্টগ্রাম, চকরিয়া, রামু, কক্সবাজার ও টেকনাফের বেশ কিছু ইয়াবা ব্যবসায়ীর সাথে নাইক্ষ্যংছড়ির নব্য ইয়াবা পাচারকারীদের মধ্যে গড়ে উঠেছে সখ্যতা। রাখব বোয়াল ব্যবসায়ীরা নাইক্ষ্যংছড়ির পাচারকারীদের অগ্রিম টাকা দিয়ে ইয়াবা ব্যবসায় যোগান দিচ্ছে।
ইতিপূর্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ২১ জন অনেকাংশে আত্মগোপন ভূমিকা পালন করে নতুন ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইয়াবা পাচার অব্যাহত রেখেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এসব ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সাথে দেন দরবারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মডেলের নিত্য নতুন মাইক্রো, নোহা, কার ও মোটর সাইকেলের আনাগুনা বৃদ্ধি পেয়েছে নাইক্ষ্যংছড়িতে। সড়ক পথে কোথাও এসব পরিবহণ তল্লাসী না থাকায় দিনের পর দিন ইয়াবা ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে, স্থানীয় সচেতন একাধিক বাসিন্দা জানান, সম্প্রতি নাইক্ষ্যংছড়ির বহু পরিচিত মুখ ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়েছে। যাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে রাতরাতি হয়েছে পরিবর্তন। তবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া ব্যাক্তিদের নিয়ে প্রশাসনের নিশ্চুপ ভূমিকা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মাঝেমধ্যে প্রশাসন সংশ্লিষ্ট কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তারা শতভাগ নিশ্চয়তা ছাড়া অভিযান চালাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। যার কারনে স্থানীয়রা দেখেও না দেখার ভান করে রয়েছে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে নাইক্ষ্যংছড়ি ৩১ বিজিবি জোনের অধিনায়ক লে.কর্ণেল হাসান মোরশেদ জি প্লাস বলেন- ‘নুতন গাড়ি প্রবেশ সংক্রান্ত কোন তথ্য নেই’’ ইতিপূর্বে ইয়াবার গোপন তথ্যের ভিত্তিতে উপবন এলাকা, চাকঢালাসহ কয়েকটি অপারেশ চালানো হয়েছিল। তবে বিশ্বাসযোগ্য কোন তথ্য না পেলে বিজিবির একার পক্ষে দুষ্কর হয়ে পড়ে। এরপরও গত কয়েক মাস যাবত দিন-রাত বিজিবি নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তথ্য উদঘাটন ও সড়ক তল্লাসীসহ ইয়াবা প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে।
পাচারকারীদের বিভিন্ন ফন্দি ও গোপনীয়তার পরও নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে গত দেড় বছরে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আটক করতে সক্ষম হয়েছেন। যার মধ্যে ২০১৪ সালে ৭ এপ্রিল আশারতলী সীমান্ত থেকে ৩০ হাজার ৩৫পিচ ইয়াবাসহ পাচাকারী ফয়েজ উদ্দিন, ১৭ এপ্রিল ২০১৪ইং চাকঢালা থেকে ১৪ হাজার ইয়াবাসহ পাচারকারী ইসমাইল হোসেন ও আনোয়ার হোসেন, ১৭ জানুয়ারী ২০১৫ইং ৮০৭পিচ ইয়াবাসহ পাচারকারী ফরিদ আলম, ১২ জুলাই ২০১৪ইং ৯৫০পিচ ইয়াবাসহ পাচারকারী মো: সিরাজ, মীর আহামদ ও সৈয়দ হাসেম, ০৭ মে ২০১৪ইং চাকঢালা থেকে ১৮৮২ পিচ ইয়াবাসহ পাচারকারী আহামদ আজিজ, ২৭জুন ২০১৩ইং চাকপাড়া থেকে ৯৫০পিচ ইয়াবা, ১০মে ২০১৫ কচ্ছপিয়া থেকে ১৮০পিচ, ০৫ এপ্রিল ঘুমধুম থেকে ২হাজার পিচ, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০১৫ইং ঘুমধুম কচুবনিয়া থেকে ৯৮৮পিচ ইয়াবাসহ পাচারকারী আবদুর রশিদ, ৩১ জানুয়ারী ২০১৩ইং নাইক্ষ্যংছড়ি বাস স্টেশন থেকে ৭৮০পিচ ইয়াবাসহ পাচারকারী জয়নাল আবেদীন, ১৫ আগষ্ট ২০১৫ইং ঘুমধুম থেকে ৯৬০পিচ ইয়াবাসহ পাচারকারী গুরা আহামদ, আবদুর রশিদ, বদি আলম, মো: ইউনুছ ও মো: আবদুর রশিদ, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৩ নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে ৬০০ পিচ ইয়বাসহ পাচারকারী মো: কামাল উদ্দিনসহ অসংখ্য ইয়াবা চালান ও পাচারকারীকে আটক করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে গত ১৩ মার্চ ২০১৫ ইং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী সোনাইছড়ির ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম রামু থানায় আটক হলে মোটা অংকের টাকায় ক্ষুদ্র মামলার আসামী সাজিয়ে ক’দিনের মধ্যেই ছাড়িয়ে আসে।
বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়িতে ইয়াবা ব্যবসার সাথে কথিত জনপ্রতিনিধি, ঠিকাদার, ইলেক্সট্রিক্স ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যাক্তি, হুজুর, কাঠ ব্যবসায়ী, ফার্মেসী ব্যবসায়ী, মোটর সাইকেল চালক, বাগান মালিক, মোবাইল দোকানদার, চাকুরিজীবি, ঔষধ কোম্পানীর এমআর, রিক্সা চালক, বেকার যুবক, সেলসম্যান, সমাজের অনেক সম্মানী ব্যাক্তিসহ নুতন পুরাতন অন্তত শতাধিক ইয়াবা পাচারকারী সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। যারা নিজেদের পূর্বেকার পেশাকে পুজি করে বর্তমানে মরণ নেশা ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়েছে।
সচেতন নাগরিকরা জানান, ইয়াবা পাচারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে আর প্রকাশ্যে ব্যবসা করছে তা দিবালোকের মত সত্য। কিন্তু কখন, কিভাবে ইয়াবা পাচার হচ্ছে তা হাতেনাতে ধরিয়ে দেওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে চিহ্নিত পাচারকারীদের নজরদারী ও তল্লাসী করা হলে আতংকে যত্রযত্র ইয়াবা পাচার প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে, নাইক্ষ্যংছড়ি থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো: আবুল খায়ের জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাটি আমাদের কাছে নেই। তবে আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নামের তালিকা তৈরী করা হচ্ছে। এছাড়াও ইয়াবাসহ আইন বিরোধী সব ধরনের কর্মকান্ড প্রতিরোধের জন্য পুলিশ বিভিন্ন স্থানে তল্লাসী অভিযান চালায় বলে তিনি দাবী করেন।
সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) এক গোপন প্রতিবেদনে বলা হয় মিয়ানমার সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সংসদ ও দেশটির শান প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা মংডু ও বুচিডং এলাকার সীমান্তরক্ষী, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা, কাস্টমস, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাজে লাগিয়ে ইয়াবা ব্যবসা করছেন। এ জন্য বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ১৫টি স্থানে কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।