কোন দেশের জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত নারী উন্নয়ন। আর এজন্য দরকার সমাজের সর্বস্তরে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা্ । বাংলাদেশের জনসংখ্যার অনেকটা অংশ জুড়েই নারী। আশার কথা হলো বাংলাদেশের নারীরা রাজনীতি সহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সমান ভাবে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো দেশে নারী নির্যাতনের হার আশংকাজনকভাবে বাড়ছে। সকালে টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা পত্রিকার প্রথম পাতায় চোখ রাখলেই দেশের কোন না কোন স্থানে নারী নির্যাতনের ঘটনা জানা যায়। নারী ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, নারী হত্যা, অ্যাসিড থ্রোয়িং, ইভটিজিং, সালিশের নামে নির্যাতনসহ নারীর বিরুদ্ধে নানা ধরনের অমানবিক পৈশাচিকতা এখন নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার।
বাংলাদেশ সংবিধানে নারীর মর্যাদা রক্ষায় নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। যেমন সংবিধানে বলা হয়েছে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবেন [অনুচ্ছেদ ১৯ (৩)] । রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন [অনুচ্ছেদ ২৮ (২)] । কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁর প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না [অনুচ্ছেদ ২৯ (২)] । এছাড়াও সংবিধানের আরও অনেক অনুচ্ছেদে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিধান প্রযুক্ত আছে ।
সংবিধানের পাশাপাশি বাংলাদেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে অতীতে নারী ও শিশু নির্যাতন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় তা প্রতিরোধে মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯, মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১, মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রীকরণ) আইন, ১৯৭৪, যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন, ১৯৮০, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ পাস করা হয়। পরবর্তীতে নারী নির্যাতন বন্ধে ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ বিধান পাস করা হয়। পরে আইনটি বাতিল করে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং ২০০৩ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন প্রণয়ন সহ এসিড-সন্ত্রাস দমন আইন ২০০২ ও পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ প্রণয়ন করা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশে ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় নারী নীতি আইন প্রণয়ন করা হয় যা পরবর্তীতে যথাক্রমে ২০০৪ ও ২০০৮ সালে সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ ২০১১ সালে পুনরায় নারী নীতি প্রণয়ন করা হয় । সুতরাং উপরোক্ত আলোচনায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বাংলাদেশে প্রণীত হয়েছে অনেক আইন। এসব বিধান থাকার মানে হচ্ছে বাংলাদেশের কোনও ক্ষেত্রে নারীর প্রতি কোনও রকম বৈষম্য ও নির্যাতন করা যাবে না । কিন্তু এসব আইন থাকা সত্ত্বেও এখনো অনেক নারী ঘরে বাইরে দেশের সর্বক্ষেত্রেই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
২০১১ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) কর্তৃক পরিচালিত ‘ Violence against Women Survey’ নামের জরিপের তথ্য অনুসারে কর্মস্থলে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। পরিবারে নির্যাতনের শিকার নারীর সংখ্যা ৮৭ দশমিক ৭ শতাংশ। দেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন, ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশ মানসিক এবং ৫৩ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হন। জরিপ আরো উল্লেখ করেছে যে, শারীরিক নির্যাতনের শিকার এসব নারীদের মাত্র অর্ধেক চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পান। BBS জরিপ অনুযায়ী, শহরের তুলনায় গ্রামে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেশি। জরিপ অনুযায়ী ৭ শতাংশ নারী নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা প্রচেষ্টা চালান । জরিপে চার ধরনের নির্যাতন যেমন: শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে । শারীরিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে স্বামীর চড় বা ঘুষি আঘাতে আহত হন ৪৫ শতাংশ এবং লাথি বা মারধরের শিকার হন ১৫ শতাংশ নারী। যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর সঙ্গে শারীরিক মিলনের সময় আহত হন ২৬ শতাংশ নারী আর স্বামীর ভয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শারীরিক মিলনে বাধ্য হন ৩০ শতাংশ ।জরিপটি আরো বলেছে, ৬৫ শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামীর কোন না কোন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। জরিপ অনুযায়ী, অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হন বিবাহিত নারীদের প্রায় অর্ধেকই। ৩০ শতাংশ নারী মনে করেন যে তাদের স্বামীরা তাদেরকে হাতখরচ দিতে চান না। ১৬ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতন, ২৬ শতাংশ মানসিক নির্যাতন আর ২৯ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হন। ২০১৭ সালে ক্রমশ নারী নির্যাতন বৃদ্ধির সাথে যুক্ত হয়েছে কন্যা শিশু নির্যাতনের বিষয়টি। ১৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কর্তৃক প্রণীত নারী নির্যাতনের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭ সালের প্রথম ১০ মাসে ধর্ষণসহ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৭৩৭টি। গত বছর ১২ মাসে একই ধরণের ঘটনার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৫৩টি। সে হিসেবে এসব ঘটনা বেড়েছে ২৮৪টি। ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ১৮৮৭টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ৯ মাসে ৪৯৩টি ধর্ষণ, ৪৩০টি হত্যা এবং ১৭৯টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নারী নির্যাতনের ধরণ ও বিশেষজ্ঞদের মতামত পর্যালোচনা করে নারী নির্যাতনের অনেক কারণ চিহ্নিত করা যায় । কারণ সমুহের মধ্যে অন্যতম হলো:
নারী নির্যাতনের বিষয়টি জাতীয় বিষয়ে পরিণত না হওয়া, দুর্বল আইনের শাসন, যৌতুক প্রথা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অপব্যবহার, নারী নির্যাতন বন্ধে আইন সমুহের ঠিকমত প্রচার না হওয়া, আইন প্রয়োগে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা যেমন: প্রণীত আইনগুলোর বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা, আইনের প্রয়োগ-পদ্ধতিতে ত্রূটি, আইন প্রয়োগে প্রভাবশালীদের প্রভাব, আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা প্রভৃতি, প্রশাসনের উদাসীনতা, নারী নির্যাতনের ঘটনাকে স্বাভাবিক বিষয় মনে করা, নির্যাতিতদের চুপ করে থাকা, ভাগ্য বলে মেনে নেয়া, নারীর প্রতি সংঘটিত অপরাধকে খাটো করে দেখা, সাক্ষীকে ভয় দেখানো, প্রভাবশালীদের অর্থের প্রলোভন ও নির্যাতিত পরিবার ঘটনা চেপে যাওয়ার চেষ্টা, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের অভাব, পিতৃতন্ত্র ও বৈষম্যমূলক আইন, তদন্তে গাফিলতি, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, বাল্যবিবাহ নারী সহ আরো অনেক কিছুই নারী নির্যাতন বৃদ্ধির কারণ ।
আলোচনার পরিশেষে একথা বলা যায় যে, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আমাদের দায়িত্বশীল হতে হব এবং একই সাথে মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা পরিবর্তন করতে হবে। নারী নির্যাতন ইসলাম সমর্থন করে না। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নারীদের জন্য ঠিক তেমনি ন্যায়সংগত অধিকার আছে যেমন পুরুষদের অধিকার আছে তাদের ওপর। তবে দায়িত্ব-কর্তব্যের দিক থেকে নারীদের ওপর পুরুষদের মর্যাদা রয়েছে। আর আল্লাহ সর্বময় শক্তিমান মহাপ্রজ্ঞাময়।’ (সূরা বাকারা, ২:২২৮) । অন্যত্র বলা হয়েছে ‘নারীরা তোমাদের পোশাক আর তোমরা তাদের পোশাক’ (সূরা বাকারা, ২:১৮৭) । দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে দেশের জাতীয় উন্নয়ন অসম্ভব। একথা ভূলে গেলে চলবে না যে, নারী-পুরূষ সমান অধিকারী । সঙ্গত কারনেই নারী নির্যাতন প্রতিরোধ এখন সময়ের দাবী । বাংলাদেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নিম্নোক্ত সুপারিশ সমুহ বিবেচনা করা যেতে পারে:
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে পারিবারিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা; নারী নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়–প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করা; নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্ব ক্ষেত্রে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা; ধর্ষণের মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করা; বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭-এর বাস্তবায়ন করা; নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; নারী নির্যাতনের ঘটনায় প্রত্যেক অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করা; নারী নির্যাতন দমনে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করা; শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমুহে নারী নির্যাতন বিষয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা করা; ধর্ষিতার জন্য অবমাননাকর হওয়ায় বাংলাদেশে প্রচলিত সাক্ষ্য আইনের সংশোধন করা; নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করে আইনটিকে আরও যুগোপযোগী করা; কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীদের উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধ করা; সাক্ষী ও ভিকটিমকে নিরাপত্তা প্রদান করা; ডাক্তারি পরীক্ষা ও তদন্ত-প্রক্রিয়া নারীদের দ্বারা হওয়া; নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১১-এর গ ধারার অপব্যবহার রোধ করা; নৈতিকতা ও মূল্যবোধের দ্বারা নিজেকে দায়বদ্ধ করা; নাগরিক দায়দায়িত্ব বাড়া এবং সর্বোপরি তীব্র সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
লেখকঃ
মামুন নিলয়, উন্নয়ন কর্মী।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।