আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি যাবে বা যাওয়া উচিত, সার্বিকভাবে এ আলোচনাই দলটির মধ্যে এখন বেশি। কিন্তু কিভাবে বা কতটা ছাড় পেলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে—এ প্রশ্নে বিএনপি নেতাদের মধ্যে মতের বেশ অমিল আছে।
দলটির বড় একটি অংশ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কিছুতেই নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষপাতী নয়। তাদের ভাষ্য, শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান থাকলে ভোট সুষ্ঠু হবে না। তিনি নির্বাচন প্রভাবিত করবেন—এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে ওই অংশ বলছে, বিএনপিকে বিরোধী দলের আসনে বসানোর কূটকৌশল করছে সরকার। কিন্তু এ ফাঁদে পা দেওয়া ঠিক হবে না।
আর উদারপন্থী বলে পরিচিত অংশটি এখনই কঠোর অবস্থান না নিয়ে আলোচনার পথ খোলা রাখার পক্ষে। তাদের মতে, দরকষাকষির মাধ্যমে কিছু দাবি আদায় করার পাশাপাশি শেখ হাসিনার ক্ষমতা খর্ব করা গেলেই নির্বাচনে যাওয়া যাবে। কারণ জনমত পুরোপুরি বিএনপির পক্ষে আছে বলেই মনে করে তারা। ওই অংশের মতে, নির্বাচনী জোয়ার তৈরি করা গেলে প্রশাসন ব্যবহার করেও পার পাবে না আওয়ামী লীগ। তাই এ কথায় ‘শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবই না’—এমন কথা এখনই বলে সংকট তৈরি করতে রাজি নয় এ পক্ষটি। তা ছাড়া একতরফা আরেকটি নির্বাচনের আয়োজন শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সরকার করে কি না তাও দেখার পক্ষপাতী এ অংশটি।
গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতে, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি নেতাদের বক্তব্য দেখে মনে হয়, তাঁদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। তিনি বলেন, আগেভাগেই অমুকের অধীনে নির্বাচনে যাব না বলে শর্তজুড়ে দেওয়া ঠিক নয়। যাঁরা এমন শর্ত দেন, তাঁদের কাছে প্রশ্ন ‘বিএনপি নির্বাচনে যাবে না তো কী হাওয়া খাবে? আবার বিনা শর্তে নির্বাচনে যাওয়ার আগেও হিসাব করে দেখে নেওয়া উচিত যে তারা কয়টি আসন পাবে—যোগ করেন বিশিষ্ট এ মুক্তিযোদ্ধা। ’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে সরকারকে কোনোভাবেই ছাড় দিতে রাজি নন বিএনপির কট্টরপন্থী বলে পরিচিতরা। ওই অংশের মতে, যা হওয়ার হোক, তবু শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন নয়। এর জন্য কেয়ামত পর্যন্ত অপেক্ষার কথাও বলছেন কেউ কেউ।
সূত্রমতে, ওই অংশ এখনই সরকারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে। আর এ জন্য তারা বিগত ৫ জানুয়ারির মতোই এবারও নির্বাচনে না যাওয়ার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তাদের যুক্তি, শেখ হাসিনার অধীনে গেলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যাওয়াই উচিত ছিল। আর তাঁর অধীনে আগামী নির্বাচনে গেলে দুই নির্বাচনকেই বৈধতা দেওয়া হবে বলে মূল্যায়ন তাঁদের।
তবে বিএনপির প্রভাবশালী আরেকটি অংশ এ প্রশ্নে কিছুটা কৌশলী অবস্থান নিয়ে সমঝোতার পথ খোলা রাখতে চাইছে। আর এ জন্যই ‘শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাব না’—এ ঘোষণা সরাসরি না দিয়ে তারা বলছে, শেখ হাসিনার অধীনে এ দেশে নির্বাচন হবে না।
এ অংশের প্রকাশ্য অবস্থান হলো নির্বাচনকালে সহায়ক সরকারের দাবি আদায় করেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে।
সম্প্রতি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক আলোচনা সভায় বলেছেন, নির্বাচন হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে। আর পৃথক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, আগামী নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনে হবে না। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতা না ছাড়লে জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁকে হটিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীন ভোট দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাবে।
জানতে চাইলে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করেই নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলছি। অর্থাৎ এ দাবি প্রতিষ্ঠিত হলেই শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় থাকেন না। সুতরাং আমাদের এ বক্তব্যের মধ্যে আগামী দিনের রাজনীতি, সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক চাপ সব কিছু রয়েছে। ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন সরকার ইচ্ছা করলেও সম্পন্ন করতে পারবে না—এ কথাই আমরা বলছি। ’
স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী আরেক নেতা লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমানের মতে, নির্বাচন এখনো অনেক দূরে থাকায় সম্ভবত সরকারকে চাপে ফেলার জন্য একেক নেতা একেকভাবে বক্তৃতা করছেন। কিন্তু বাস্তবে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না তা বলার সময় এখনো আসেনি। তাঁর মতে, ভোট ঘনিয়ে এলে তখন বক্তৃতার এ সমন্বয়হীনতা এমনিতেই দূর হয়ে যাবে।
যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে এমন আরেক প্রভাবশালী বিএনপি নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, “নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলে আসলে আমরা ‘পজেটিভলি নেগেটিভ’ অবস্থান প্রকাশ করছি। অর্থাৎ নির্বাচনে যাব, কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা প্রয়োজন সেই দাবিও আদায় করব। আর নির্বাচনে না যাওয়ার কথা যাঁরা বলেন, সম্ভবত তাঁদেরও জানা নেই পরবর্তী সময়ে কী হতে পারে”—যোগ করেন নির্বাচনে যেতে আগ্রহী ওই নেতা। তাঁর মতে, নির্বাচনে যাওয়ার কথা বললে বরং বিএনপির পেছনে জনগণ ঘুরে দাঁড়াবে।
বলা বাহুল্য, দলের এ অংশই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের একটি প্রস্তাবনা দেওয়ার পক্ষে এবং এসংক্রান্ত প্রস্তাবনা দেওয়া হবে বলে এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি এ পর্যন্ত দলীয় ফোরামের কোনো বৈঠকে তিনি তোলেননি। যদিও সর্বশেষ গত রবিবার রাতে গুলশান কার্যালয়ে বিএনপি সমর্থক পাঁচ বুদ্ধিজীবী নির্বাচনে যাওয়ার জন্য তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন। ওই দিন উপস্থিত সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, বিএনপি গলাকাটা পার্টি নয় যে নির্বাচনে যাবে না।
একই দিন সেখানে উপস্থিত গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এ বক্তব্যকে সমর্থন করে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে যাওয়ার পরামর্শ দেন বলে জানা যায়।
তবে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রথম থেকেই বলে আসছেন, শেখ হাসিনার অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। সর্বশেষ গত ১০ মার্চ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির এক আলোচনা সভায় স্পষ্ট করেই তিনি বলেন, কেয়ামত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলেও শেখ হাসিনার অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। তাঁর এ বক্তব্যকে কঠোর অবস্থান বলে দলের অনেকে মনে করছেন।
আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নে দলীয় নেতাদের বক্তব্যের অর্থ একই কি না জানতে চাইলে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, হুবহু না হলেও অর্থ একই দাঁড়ায়। তিনি বলেন, ‘আমি যে বক্তব্য (হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাব না) দিয়েছি সেটিই সঠিক এবং দলীয় অবস্থান। ’ কিন্তু দুই ধরনের বক্তব্য মতবিরোধ বা সমন্বয়হীনতা কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি বলতে পারব না। সাংবাদিকরা যা ইচ্ছা মনে করতে পারেন। ’
দলের অনেকেই এখন তাঁর লাইনে বক্তৃতা দিচ্ছেন এমনটি দাবি করে গয়েশ্বর বলেন, সম্ভবত দলের হাইকমান্ডের চাপে এটি হতে পারে।
কিন্তু আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপি ভেঙে যেতে পারে—এমন সম্ভাবনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী এ নেতা বলেন, দল ছেড়ে যারা যেতে চায় যাক না। বিএনপিতে ৩০ লাখ নেতাকর্মী আছে; সেখান থেকে ৩০০ দল ছেড়ে গেলে বিএনপির ক্ষতি হবে না।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।