জাতীয় শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষাসহ শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কাজে শিক্ষা এবং প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের অভাবে সঙ্কট বাড়ছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমপনী পরীক্ষা নিয়ে নিত্য নতুন ঘোষণায় অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে দুই কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মাঝে। এদিকে প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষানীতির বাইরে গিয়ে পঞ্চম শ্রেণীর শিশুদের ওপর পাবলিক পরীক্ষার বোঝা চাপানো নিয়ে। শিক্ষাবিদরা পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর হলে পশ্চম শ্রেণীর পরীক্ষা অগ্রহণযোগ্য। এখন সময় হয়েছে শিশুদের নিয়ে ‘এক্সপেরিমেন্ট’ বন্ধ করার।
চলতি বছর থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত হওয়ায় অষ্টম শ্রেণী শেষেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা হওয়ার কথা। সে হিসেবে শিশুদের পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষা বাতিলে সারাদেশে ব্যাপক দাবির প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ‘পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষা হবে না’ বলে ঘোষণা দেয়ার পর আশ্বস্ত হয়েছিলেন সকলেই। তবে তার ঘোষণা মন্ত্রী পরিষদে বহাল রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় সেই আগের সঙ্কটেই পড়তে হচ্ছে শিশু ও তাদের অভিভাবককে। যথারীতি এখন পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে দুটি পাবলিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে শিশুদের। আবার অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার দায়িত্ব প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিলেও শেষ মুহূর্তে এসে তারা ঘোষণা দিয়েছে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা তারা নেবে না। ফলে সে পরীক্ষা নিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর যে পরীক্ষা প্রাথমিক শিক্ষামন্ত্রী বাতিলের ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি এখন বলছেন, কবে নাগাদ পরীক্ষাটি বাতিল হবে তা আমি নিশ্চিত নই। মন্ত্রিসভায় পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চলবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাইলটিংভিত্তিতে বেশকিছু সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণী চালু হলেও অর্থ সঙ্কট, অবকাঠামোর অভাব, শিক্ষক সঙ্কট ও শিক্ষকদের মর্যাদা অক্ষুণœ রাখাই নীতি বাস্তবায়নে এখন প্রধান অন্তরায় হয়ে সামনে এসেছে। নীতি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে সারাদেশের শত শত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভয়াবহ অবকাঠামো সঙ্কট। খোদ রাজধানীতেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা বেহাল। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই শিশুদের উপযোগী শ্রেণীকক্ষ। যাদের আছে তাও আকারে ছোট। অষ্টম শ্রেণী তো পরের কথা, ১৫ হাজার প্রধান শিক্ষকসহ অর্ধ লক্ষ শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত কার্যক্রমই পড়েছে সঙ্কটের মুখে। শিক্ষানীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা চালুর সরকারী উদ্যোগের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে এমন উদ্বেগজনক চিত্রই বেরিয়ে এসেছে।
প্রথমিক শিক্ষার ব্যাপ্তি ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সমাপনী পরীক্ষা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য বা উত্তর জানা নেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। এমনকি সুনির্দিষ্ট উত্তর জানা নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানের কাছেও। অথচ এসব প্রশ্নের জবাবের সঙ্গে জড়িত প্রায় আড়াই কোটি শিক্ষার্থীর পড়াশোনার ভাগ্য। প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষা হবে কি-না? এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, আমি নিশ্চিত নই। যেদিন মন্ত্রিসভা এ পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিবেন সেদিনই বাতিল হবে।
গত মে মাসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় যৌথসভা করে ঘোষণা দিয়েছিল, প্রাথমিক শিক্ষা এখন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করা হলো। এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রাথমিক শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এটা বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় মন্ত্রিসভায় প্রস্তাব পাঠাবে। শিক্ষামন্ত্রীকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, উনি ২০১৮ সালের মধ্যেই এটা বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করেছেন। আমিও সেই আশাই করছি। তবে এক্ষেত্রে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের আন্তরিকতার অভাব আছে বলে তিনি মনে করেন না।
জানা গেছে, এরই মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করছে। খাতা কলমে দেশে এখন প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই বলছেন, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। জটিলতা এড়ানোর জন্য বর্তমানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যেভাবে রয়েছে ঠিক সেভাবে রেখেই তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হচ্ছে। অর্থাৎ যেসব হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করান হচ্ছে সেসব প্রতিষ্ঠানেও অষ্টম শ্রেণী থাকবে, শুধু অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন কিলোমিটারের মধ্যে হাইস্কুল নেই শুধু সেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণীর অনুমোদন দেয়া হবে।
এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীর অনুমোদন দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করানো হচ্ছে। কিন্তু এসব বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। কোন কোন বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষকও দেয়া হয়নি। ফলে অনেক বিদ্যালয়ে এসব শ্রেণি চালু রাখাই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। ছয় বছর আগে শিক্ষানীতি জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কোন কূল-কিনারা পাচ্ছে না মন্ত্রণালয়।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেছেন, জাতীয় শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতায় দেখা দিয়োেছ। অর্থ সঙ্কট, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকা, শিক্ষক সঙ্কট ও শিক্ষকদের মর্যাদা অক্ষুণœ রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা। তিনি আরও জানান, নানা সংকটের কারণে শিক্ষানীতি বাস্তায়নে গঠিত সাব-কমিটি এমনকি দুই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কয়েক দফা বৈঠক করেও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এ বিষয়ে কমিটির সদস্যরা সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলছেনও না। দৈনিকশিক্ষা
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।