এএইচ সেলিম উল্লাহ, সম্পাদকঃ তালিকায় নাম নেই, কোনো মামলাও নেই। অথচ তিনি ইয়াবা ডন নামে পরিচিত। স্থানীয়রা তাকে চিনে ইয়াবা কাদের নামে। পুরো নাম ফজল কাদের (৩০)। কক্সবাজারের উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ডেইলপাড়া গ্রামের মৃত আজিজুর রহমানের ছেলে সে।
দুই বছর আগেও পোনা শ্রমিকের কাজ করত স্থানীয় চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী বিভিন্ন হ্যাচারিতে। হ্যাচারি থেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের রেণু পোনার চালান নিয়ে যেত সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক হিসাবে। আজ সে এখন কোটিপতি। জমি-জমা, গাড়ি-বাড়ি, শপিং মার্কেট ও সুপারি বাগানসহ রয়েছে হাজার কোটি টাকার সম্পদ। তবে দেরিতে হলেও আইন-শৃংখলা বাহিনী এই ইয়াবা ডনের খুঁজে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ কারণে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অসংখ্যবার ভারতের কলকাতা শহরে আসা-যাওয়া করেছে।
পুলিশ ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত পাঁচ বছর আগেও অর্থকষ্টে দিন চলেছে ফজল কাদেরের সংসার। মাত্র ৮শ’ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পারিশ্রমিক হিসাবে চিংড়ি পোনার চালান নিয়ে যেত সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। টাকার অভাবে লেখাপড়াও বেশি দূর এগোয়নি। অথচ সে আজ ইয়াবা কারবার করে শত কোটি টাকার মালিক। চলে দামি গাড়িতে।
গত দুই বছর আগে স্থানীয় সোনারপাড়া বাজারে অবস্থিত সাবেক ইউপি নারী সদস্য আনোয়ারা বেগমের মালিকানাধীন দুই তলাবিশিষ্ট বিলাসবহুল শপিং মার্কেটটি ৪৫ হাজার টাকায় কিনে নেয়। গত এক মাস আগে কিনে নেয় কক্সবাজার শহরের বায়তুশ শরফ হাসপাতালের পূর্বে পাশে ৭৭ লাখ টাকায় মূল্যবান জমি। এছাড়াও তার এলাকা ডেইল পাড়ায় রয়েছে বাড়ি, গাড়ি ও কোটি টাকার সুপারি বাগান। চলে রাজার হালে। ইতিমধ্যে ভ্রমণ করেছে ভারত ও সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। অদৃশ্য কারণে আজ সে এই অবস্থানে পৌঁছে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক মানুষের অভিযোগ, মিয়ানমার থেকে সমুদ্রপথে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা চালান আনছে ফজল কাদের। তার নিজস্ব ফিশিং ট্রলার করে প্রতিদিন মিয়ানমার থেকে নিয়ে এসেছে এসব ইয়াবা। সে ইতিমধ্যে বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বিশেষ করে স্থানীয় সোনারপাড়া বাজার ও কক্সবাজার শহরে প্রকাশ্যে বিচরণ তার। অথচ পুলিশ বলছে, সে আত্মগোপনে রয়েছে। এ কারণে এখন ইয়াবা কারবার চলছে ওপেন সিক্রেটভাবে। আইন-শৃংখলা বাহিনী ইয়াবাসহ মাদক প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকার কথা বলা হলেও এখনও রহস্যজনক কারণে তার গায়ে আঁচড় লাগেনি।
একদিকে ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ, অন্যদিকে ইয়াবা কাদেরের অবাধ বিচরণের ভাবিয়ে তুলেছে স্থানীয় সাধারণ মানুষকে। এ কারণে তার এলাকা ডেইলপাড়া সমুদ্র পয়েন্ট দিয়ে এখনও ইয়াবার চালান প্রবেশ করছে উখিয়া ও কক্সবাজারে। সর্বশেষ গত দুই সপ্তাহ আগেও উখিয়ার উপকূলীয় এলাকা ডেইলপাড়া নামক স্থান থেকে একটি বিশাল ইয়াবার চালান খালাস করে ফজল কাদের।
এক অনুসন্ধানে জানা যায়, টেকনাফের মৌলভীপাড়া এলাকার ইয়াবা গডফাদার ফরিদ আলমের মাধ্যমে ইয়াবা জগতে পা রাখেন ফজল কাদের। পরে তার মেয়েকে বিয়ে করে নব্য ইয়াবা গডফাদারের তালিকায় নাম ওঠায় ফজল কাদের। গড়ে তোলে জামাই-শ্বশুর মিলে যৌথ সিন্ডিকেট। দেশব্যাপি বিস্তার লাভ করে বিশাল ইয়াবার কারবার। অল্প সময়েই ইয়াবা ইয়াবার বিকিনিকি ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। তার শ্বশুরের ব্যবসার হাল ধরে ৫ বছর আগে। মোহাম্মদ আলম নামের মিয়ানমারের এক এজেন্টের কাছ থেকে ফজল কাদের দেশে আসা ইয়াবার চালানগুলো বুঝে নেন। তিনি সোনারপাড়া ও কক্সবাজারে বসেই চোরাইপথে আসা এসব ইয়াবার টাকা বুঝে নেন। মিয়ানমারের ডিলারদের সাথে উখিয়ার সোনারপাড়ার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে এসব ইয়াবা বাংলাদেশে এনে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একাধিক তালিকায় তৈরি করলেও বরাবরের মতো ফজল কাদের ও তার সিন্ডিকেট অদৃশ্য কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। একইভাবে তার একাধিক ইয়াবা চালানসহ তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা ধরা পড়লেও রহস্যজনক কারণে মামলার এজাহারে নাম থাকলেও পরে মামলার অভিযোগপত্রে নাম বাদ পড়ে যায়। সর্বশেষ গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর রামু উপজেলার মাঙ্গালাপাড়া এলাকায় একটি সিএনজি তল্লাশি করে বিজিবির সদস্যরা ৩৯ হাজার ৬শ’ পিস ইয়াবাসহ আহমদ শরিফ নামের এক ইয়াবা কারবারিকে আটক করে র্যাব।
ওই সময়ে আটক আহমদ শরীফ র্যাবের কাছে স্বীকার করেছে, ইয়াবাগুলো ফজল কাদের ও তার শাশুড়ি আমিনা খাতুনের কাছ থেকে ক্রয় করে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাচ্ছিল। তার স্বীকারোক্তি মতে র্যাব বাদি হয়ে রামু থানায় একটি মামলা নং (০২/৩২১) দায়ের করেন। পরে ওই মামলার দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর কক্সবাজার আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন রামু থানা পুলিশ।
ওই তদন্ত প্রতিবেদনে ইয়াবাসহ আটক আহমদ শরীফ ও ফজল কাদেরের শাশুড়ি আমিনা খাতুনের নাম থাকলেও বরাবরের মতো রহস্যজনক কারণে নব্য ইয়াবা ডন ফজল কাদেরের নাম বাদ পড়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে তার সেকেন্ট ইন কমান্ড দক্ষিণ সোনারপাড়া গ্রামের মাস্টার জাকের হোসেনের ছেলে লুৎফর রহমানের সহযোগিতায় ইয়াবা কারবারের মামলা থেকে বাদ যাচ্ছে। এই নব্য ইয়াবা ডন দেশের বাইলে থাকলে পুরো ইয়াবা কারবারটি ওই লুৎফর রহমানই পরিচালনা করে থাকে। সর্বশেষ রামু থানার মামলাটিও লুৎফর রহমান পুলিশের সাথে আঁতাত করে মামলার চার্জশিট থেকে নাম বাদ দিয়েছে পুলিশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রামু থানার ওসি আবুল মনছুর বলেন, ইয়াবা নিয়ে আটক ওই মামলার আসামি আহমদ শরীফ স্বীকারোক্তি দিলেও ফজল কাদের দেশের বাইরে ছিল। এ কারণে উক্ত মামলার সাথে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই। ফলে তার নামটি আইনগতভাবে তদন্ত প্রতিবেদনে আসে না। অবশ্য, ফজল কাদের একজন ইয়াবা ডন হিসাবে স্বীকার করেছেন ওসি।
জানতে চাইলে উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল খায়ের বলেন, ‘ফজল কাদের নামের এই ইয়াবা ডন এখন পলাতক রয়েছে। পুলিশ তাকে ধরার চেষ্টা করছে। এছাড়াও চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে উখিয়ার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ইয়াবা ও মাদকের চালান আটক করছে পুলিশ। ইয়াবা পাচারে সাধারণ মানুষ জড়িয়ে পড়ায় শত চেষ্টা করেও ইয়াবা প্রতিরোধ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: ইকবাল হোসেন বলেন, ‘তালিকায় নাম নেই, কোন থানায় মামলাও নেই। অথচ এই রকম অনেকেই রয়েছে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। এতদিন তথ্য-প্রমাণের অভাবে তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু, এখন পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেই তার আয়ের উৎস ও মুখোশ উন্মোচন করবে।’
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।