কৃষি শ্রমিক, রিকশাচালক, দিনমজুর, গৃহকর্মীসহ ৬০টি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড (ভবিষ্য তহবিল) চালু করছে সরকার। এসব খাতে কর্মরত নারী-পুরুষের প্রভিডেন্ট ফান্ড চালুর জন্য ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ তহবিল নীতিমালা-২০১৭’ প্রণয়ন করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। সারা দেশের পোস্ট অফিসের মাধ্যমে এই তহবিলের লেনদেন হবে। সরকারের এমন পদক্ষেপে পোস্ট অফিসগুলোও পুনরুজ্জীবিত হবে। নীতিমালাটি মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য ইতিমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নানা ধরনের প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু রয়েছে। বড় বড় মিল-কলকারখানার শ্রমিকরাও এই সুবিধা পায়। কিন্তু কৃষক, রিকশাচালক, কামার, কুমার, জেলেসহ সমাজের একটি বড় অংশের জন্য কোনো প্রভিডেন্ট ফান্ড সুবিধা নেই। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তন হওয়ায় সরকার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক বা দিনমজুরদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের আওতায় আনতে উদ্যোগী হয়েছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার বলেন, ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারী-পুরুষ সবার সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন এ তহবিল পরিচালনা করবে। তহবিলটি ৫, ১০, ১৫, ২০ ও ২৫ বছর মেয়াদি হবে। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে শ্রমিকের অংশ, ফাউন্ডেশনের অংশ, সঞ্চয়ী প্রতিষ্ঠানের মুনাফাসহ জমাকৃত পুরো অর্থের ওপর বিভিন্ন হারে মুনাফা বা ইনসেনটিভ দেওয়া হবে। এই মুনাফা পাঁচ বছর মেয়াদের পর ৫ শতাংশ, ১০ বছর মেয়াদের পর ৭ শতাংশ, ১৫ বছর মেয়াদের পর ১০ শতাংশ, ২০ বছর মেয়াদ পূর্তিতে সাড়ে ১২ শতাংশ এবং ২৫ বছর মেয়াদ পূর্তিতে হবে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ। ’
প্রভিডেন্ট ফান্ডে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকরা নানা ধরনের অর্থিক সুবিধা পাবে। কোনো কারণে মানসিক বা দৈহিকভাবে অক্ষম হলে তাকে দুই লাখ টাকা দেওয়া হবে। কোনো শ্রমিক মারা গেলে তার নমিনিকে দেওয়া হবে দুই লাখ টাকা। অংশগ্রহণকারী প্রভিডেন্ট ফান্ড চালুর তিন বছর পর এইডস, ক্যান্সার, পোলিও, আর্থ্রারাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাঁপানি, ডায়াবেটিস বা ইবোলার মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা দেওয়া হবে। এ তহবিলের নারী সদস্য গর্ভবতী হলে পাবেন ২৫ হাজার টাকা। তবে একজন নারী সদস্য দুইবারের বেশি এ সুবিধা পাবেন না।
ভবিষ্যৎ তহবিলে অংশগ্রহণের জন্য অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের ফরম পূরণ করে নির্ধারিত সঞ্চয়ী প্রতিষ্ঠানে প্রতি মাসে এক শ বা তার গুণীতক হারে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা জমা করতে পারবে। প্রতি মাসের ৫ তারিখের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ অ্যাকাউন্টে জমা করতে হবে। একসঙ্গে সর্বোচ্চ ছয় মাসের টাকাও জমা করা যাবে। পর পর ছয় মাস তহবিলের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরিচালনা বোর্ড প্রভিডেন্ট ফান্ডের কার্যক্রম বাতিল করতে পারবে।
মালিক বা নিয়োগকর্তা ইচ্ছা করলে তাঁর শ্রমিকের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক অবস্থার কথা চিন্তা করে এ তহবিলে যেকোনো পরিমাণ টাকা জমা করতে পারবেন। শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে ১০০ বা ২০০ টাকা জমা করলে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনও সমপরিমাণ টাকা জমা করবে। আর শ্রমিক ৩০০, ৪০০ বা ৫০০ টাকা হারে মাসে জমা করলে ফাউন্ডেশন ২৫০ টাকা হারে জমা করবে।
যেসব খাতের শ্রমিকরা এ সুবিধার আওতায় আসবে : ৬০টি পেশার শ্রমিকরা এই সুবিধা পাবে। উৎপাদন খাতের কৃষি শ্রমিক, বর্গা চাষি ও কৃষিনির্ভর মৌসুমি শ্রমিক, কামার, কুমার, তাঁতি, মৎস্য শ্রমিক, পোল্ট্রি ও ফিশারিজে নিয়োজিত শ্রমিকরা এর আওতায় আসবে। গবাদি পশু পালন শ্রমিক, বনায়ন ও নার্সারি শ্রমিক, কুটির শিল্পে নিয়োজিত কারিগর, ঠোঙা-বুক বাইন্ডিং শ্রমিকরা এই প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকা জমা রাখতে পারবে। স্ব-নিয়োজিত বিভিন্ন খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকরাও এই সুবিধা পাবে।
নির্মাণ শ্রমিক, মাটিকাটা শ্রমিক, কাঠমিস্ত্রি, রং ও পলিশ মিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, প্লাম্বার মিস্ত্রি এবং ঠিকাদার কর্তৃক চুক্তিভিত্তিক নির্মাণ খাতে নিয়োজিত শ্রমিক এই ফান্ডের সুবিধার আওতায় আসবে।
সেবা খাতের গৃহকর্মী, মালি, হকার ও ফেরিওয়ালা, নিরাপত্তা কর্মী, দর্জি, সেলুন কর্মচারী, বেকারি শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, ফোন-ফ্যাক্স-কম্পিউটার বা ফটোকপিয়ারের কাজে নিয়োজিত শ্রমিক, নৌকার মাঝি, হাট ও ঘাট শ্রমিক, বেডিং শ্রমিক, ছাতার কারিগর, জুতার কারিগর, রিকশা, ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি চালকরা এই তহবিলের সুবিধা নিতে পারবে।
দেশীয় তৈরি যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক যানবাহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক, স্টিল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কাজে নিয়োজিত শ্রমিক, গ্রিল ও ওয়েল্ডিং শ্রমিক, মোটর গ্যারেজ শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, দিনমজুর ও গাড়িচালক, চাতাল, হোটেল ও রেস্টুরেন্টে নিয়োজিত শ্রমিকরা এই সুবিধা পাবে। বিউটি পার্লারে নিয়োজিত শ্রমিক, হাসপাতাল-ক্লিনিকে রোগীর সেবায় নিয়োজিত আয়া, আলোকসজ্জা, ডেকোরেটর, সাউন্ড সিস্টেম, বাদ্যযন্ত্র, সাংস্কৃতিক দলের কাজে নিয়োজিত কর্মীরাও এই নীতিমালার আওতায় আসবে।
শ্রমিককে যা করতে হবে : শ্রমিকদের তার পেশা প্রমাণের জন্য সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মেয়র, কাউন্সিলর বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে সনদপত্র নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নভুক্ত হলে সনদপত্রটিতে ট্রেড ইউনিয়নের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের প্রতিস্বাক্ষর নিতে হবে। আর ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য না হলে শ্রমিকের নিয়োগকর্তা, জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত যেকোনো প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার প্রতিস্বাক্ষর লাগবে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দপ্তরগুলোর যেকোনো কর্মকর্তার প্রতিস্বাক্ষরেও এ তহবিলের সদস্য হওয়া যাবে।
অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের নিয়োগকর্তা কাকে বোঝাবে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, এখানে নিয়োগকারী অর্থই হচ্ছে যে ব্যক্তি শ্রমিককে কাজ দেবেন তিনি। যেমন গৃহকর্মীর ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তা গৃহকর্তা, নিরাপত্তা প্রহরীর ক্ষেত্রে ভবন বা প্রতিষ্ঠানের মালিক, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার।
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, যে এলাকায় পোস্ট অফিস নেই সেখানে কর্মসংস্থান ব্যাংক, প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক, সঞ্চয়ী ব্যাংক, পল্লী সঞ্চয়ী ব্যাংকে এই প্রভিডেন্ট ফান্ডের অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে। একপর্যায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংকে এ হিসাব খোলা যাবে। অ্যাকাউন্ট খোলার পর শ্রমিককে একটি ক্যাশকার্ড দেওয়া হবে। প্রতি বছর প্রাপ্য মুনাফাসহ আসল এই ক্যাশ কার্ডে জমা থাকবে। সব ধরনের লেনদেন সম্পন্ন হবে ক্যাশ কার্ডের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।