সোর্সের তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় গত বৃহস্পতিবার সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়িতে আতিয়া মহলকে জঙ্গি আস্তানা হিসেবে শনাক্ত করে পুলিশ। এর পর শুক্রবার ভোর থেকে সেখানে থাকা জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। জবাবে ভেতর থেকে পুরুষ কণ্ঠে একজন বলেন, ‘দেরি করছ কেন, সময় নেই, তাড়াতাড়ি সোয়াট পাঠাও।’ কেন জঙ্গিরা দ্রুত সোয়াটকে জঙ্গি আস্তানায় যাওয়ার আহ্বান জানাল- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আতিয়া মহলের নিচতলায় পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াটের জন্য বোমা-বারুদের ফাঁদ পেতেছিল জঙ্গিরা। নিচতলাজুড়ে তারা উচ্চশক্তির বিস্ফোরক লাগিয়ে রেখেছিল। নানা জায়গায় ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) পেতে রাখা হয়েছিল। সোয়াট এলেই তাদের নিয়ে নিচতলাসহ উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল জঙ্গিদের। তাই অভিযান-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বেঁচে গেছেন সোয়াট সদস্যরা। জঙ্গিদের আহ্বানের পর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পর ডাক পড়ে সেনা কমান্ডোদের। শনিবার থেকে শুরু হয় তাদের অভিযান। জঙ্গিবিরোধী এ অভিযানের মধ্যেই জঙ্গিরা টাইমবোমা হামলা চালায়। এতে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জন নিহত হন। আহত হন আরও অর্ধশতাধিক।
জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডের খোঁজ রাখেন এমন একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, সম্প্রতি নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতারা তাদের সহযোগীদের নির্দেশ দেয়, নিরাপত্তার জন্য সব আস্তানায় ভারী বোমা ও বিস্ফোরকের মজুদ গড়ে তুলতে হবে। সন্ধান পেয়ে পুলিশ কোনো আস্তানায় অভিযানে গেলে হামলা করে তাদের ভাষায় ‘কবর’ বানিয়ে ফেলার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তাই জঙ্গিরা এখন তাদের অনেক আস্তানায় ভারী বিস্ফোরক ও বোমা রাখছে। সম্প্রতি সীতাকুণ্ডে জঙ্গি আস্তানায় তা দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেনা কমান্ডোদের প্রথম লক্ষ্য ছিল ভবনে আটকেপড়াদের কৌশলে উদ্ধার করা। কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই শনিবার ৭৮ জনকে তারা উদ্ধার করেন। এরপর তারা ভার্টিক্যাল পদ্ধতিসহ নানাভাবে অপারেশন চালান। অভিযানের মুখে জঙ্গিদের পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলার ধরন সম্পর্কে অনেকে খোলাখুলি বলেছেন, ভেতরে থাকা জঙ্গিরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা সুইসাইড ভেস্ট ব্যবহার করে। গতকাল সোমবার সকালেও ভেতর থেকে অন্তত দুই রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। এর আগে জঙ্গিরা নিচতলায় ফ্ল্যাটে প্রবেশ কক্ষের সামনে একটি ফ্ল্যাটে বসিয়ে রাখে।
নিহতদের পরিচয় মেলেনি: এদিকে, সেনা কমান্ডো অভিযানে নিহত জঙ্গিদের পরিচয় এখনও মেলেনি। তাদের বয়স সম্পর্কেও কোনো ধারণা পাননি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তবে আতিয়া মহলে যারা ছিল, তারা সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বলেই সংশ্লিষ্টদের ধারণা। তারা বলছেন, এ আস্তানায় নব্য জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের মুসা ও মিরপুর থেকে পালানো ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র রাফিদ হাসানও থাকতে পারে। এ ছাড়া মনজেয়ারা পারভীন ওরফে মর্জিনা নামের এক নারী জঙ্গির কথাও শোনা যাচ্ছে। মর্জিনা সীতাকুণ্ডে অভিযান অ্যাসল্ট-১৬-তে নিহত জোবায়দা ইয়াসমিনের বোন। তাদের গ্রামের বাড়ি নাইক্ষ্যংছড়িতে। তবে মর্জিনার ভাই তারেক গতকাল সমকালকে জানান, মর্জিনা সিলেটের কোনো জঙ্গি আস্তানায় মারা গেছে এমন কোনো তথ্য তাদের জানা নেই।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, সিলেটে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়ার পর অভিযানের সময় জঙ্গিদের প্রথম পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় তাদেরই কোনো ভিন্ন গ্রুপ প্রাণঘাতী টাইমবোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) বাসুদেব বণিক সমকালকে বলেন, সেনা কমান্ডোদের অভিযানে নিহত চারজনের পরিচয় জানা যায়নি।
বোমার কারিগরদের খোঁজে গোয়েন্দারা: দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন ধরে জেএমবির বোমা তৈরির মূল কারিগর ছিল বোমা মিজান। তবে এখন শুধু বোমা মিজান একা নয়, তার সঙ্গে সাগর, আবদুস সামাদ ওরফে মামু, হাতকাটা সোহেল মাহফুজও যুক্ত রয়েছে। তাদের আরও কয়েকজন শিষ্য আছে, যারা বোমা তৈরিতে পারদর্শী। প্রতিবেশী একটি দেশের খনিতে ব্যবহৃত বিস্ফোরক চোরাপথে দেশে এনে বোমা তৈরিতে ব্যবহার করছে জঙ্গিরা। এর বাইরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভুয়া ল্যাবরেটরিয়ান পরিচয়ে বিভিন্ন মার্কেট থেকে কেমিক্যাল কিনছে জঙ্গিরা। সম্প্রতি সীতাকুণ্ডে অভিযানের পর ওই আস্তানা থেকে পাঁচ কেজি গানপাউডার পাওয়া যায়। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এক দশক আগেও যে প্রক্রিয়ায় জঙ্গিরা বোমা তৈরি করেছিল, এখনও তারা একই পথ অনুসরণ করছে। তবে তারা আগের চেয়ে আকারে বড় বোমা তৈরি করছে।
মামলা: শিববাড়িতে টাইমবোমা হামলার ঘটনায় অজ্ঞাতদের আসামি করে রোববার রাতে মামলা হয়েছে। মোগলাবাজার থানার এসআই শিপলু চৌধুরী বাদী হয়ে বিস্ফোরক ও দণ্ডবিধির ধারায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন ওই থানার ওসি খায়রুল ফজল। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৫ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ির গোটাটিকর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসাসংলগ্ন এলাকায় অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা একটি বোমা বা গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর বোমা হামলায় আহত ২৫ জনের নাম-পরিচয় দেওয়া হয়। এ সময় একটি মোটরসাইকেল (সিলেট হ-০৪-১১৪৬) বোমার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়। আরও বলা হয়, সিলেটে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিমের প্রধান মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ-সাতজন একটি পরিত্যক্ত ব্যাগে বোমা বা গ্রেনেড দেখে এগিয়ে গেলে পরবর্তী বিস্ফোরণ ঘটে। এতে র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ, র্যাবে কর্মরত মেজর আজাদ, সিলেটের আদালতে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক চৌধুরী মো. আবু কয়ছর, জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম, দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি শাহ হারুন রশীদ, এসআই মো. শাখাওয়াত, এএসআই জলি লাল দে, কনস্টেবল মো. আরিফ, কনস্টেবল মিজান, এএসআই মো. আলী হোসেন, এএসআই আবদুর রহমান ও ল্যান্স করপোরাল আবু তাহের আহত হন। তাদের মধ্যে মনিরুল ইসলাম ও আবু কয়ছর মারা যান। এ ছাড়া মারা যান আরও চারজন। ঘটনাস্থল থেকে কাচ, স্পিল্গন্টার, লোহা, ইস্পাত, স্কচটেপ, কাপড়ের টুকরা, কাপড়ের ব্যাগের অংশ আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়। এ ছাড়া দ্বিতীয় দফার বিস্ফোরণে সিলেট-৪৩৩৪ নম্বরের আরেকটি ক্ষতিগ্রস্ত মোটরসাইকেল পাওয়া যায়।
কড়া নিরাপত্তা: অভিযানের চতুর্থ দিন গতকাল সকাল থেকে আতিয়া মহলের প্রায় এক কিলোমিটারের মধ্যে কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যম কর্মীসহ কাউকে আশপাশ এলাকায় ভিড়তে দেওয়া হচ্ছিল না। মাইকিং করে স্থানীয়দের সতর্ক করে পুলিশ। আশপাশ এলাকার কেউ জরুরি কাজে রাস্তায় বের হলে তাদের দেহ তল্লাশি করা হয়। অভিশপ্ত সেই আতিয়া মহলের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, যে আতঙ্ক নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছিলাম, তা এখনও কাটেনি। আমরা আর ওই বাসায় ফিরতেও চাই না।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।