#সাজ্জাদ নেই, আমাদের বিশ্বাস হয় না’
নিজস্ব প্রতিবেদক:
ফরেস্টার মো. রাকিব হোসেন, সফিউল আলম শুভ, শামীম হোসেন, মো. কামরুজ্জামান শোভন, জহিরুল আলম, মো. সোহেল রানা, বিকাশ দাশ, ক্যাচিং উ মারমা, শিমুল কান্তি নাথ ও মো. সাজ্জাদুজ্জামান (মরহুম) ওরা নয় বন্ধু ২০২০ সালে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগে যোগাদান করেন। যোগদান পর থেকে কক্সবাজারের বিভিন্ন বন বিটে তাঁরা কর্মরত আছেন। শুধু এখন নেই সাজ্জাদুজ্জামান সজল। বন্ধু, সহকর্মী, মরহুম সাজ্জাদুজ্জামানের সাথে স্মৃতি নিয়ে ছবি দেখে কান্না করেন ওরা ৮ বন্ধু। তাঁরা ৮ জনের মধ্যে ৭ জন কক্সবাজারে কর্মরত থাকলেও ফরেস্টার মো. রাকিব হোসেন চট্রগ্রামের পদুয়া চেক স্টেশনে কর্মরত রয়েছেন। আর এর মধ্যে পাহাড়খেকোদের নীলনকশায় পরপারে সাজ্জাদুজ্জামান সজল। নয় বন্ধু হঠাৎ এক বন্ধুকে হারিয়ে বেঁচে থাকলেও তাঁদের দু’চেখে ঘুম নেই বন্ধুর জন্য। বলতে গেলে সবাই বন্ধুর শোকে নির্বাক। মঙ্গলবার দুপুরে আট বন্ধুর মধ্যে কয়েকজনের সাথে মুঠোফোনে কথা হয় প্রতিবেদকের।
এর মধ্যে উখিয়ার থাইংখালী বনবিট কর্মকর্তা বিকাশ দাশ মুঠোফোনে প্রতিবেদকের সাথে তাঁর বন্ধু মরহুম সাজ্জাদের কথা বলতে গিয়ে কান্নাকাটি করেন। বর্ণনা দেন তাঁর সাথে হাজারো স্মৃতি। তিনি বলেন, ঘটনার দিন (রোববার) রাত ১২.৫১ মিনিটে কথা হলো সকাল ৯ টার মধ্যে উখিয়ার আসার জন্য। ওই দিন ঠিকই আমি আসলাম সে নেই.. শুধু দেখলাম তাঁর নিথর দেহটি। তাঁর নানা স্মৃতি কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্না করেন তিনি।
একই ভাবে বন্ধুর স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে কানায় ভেঙ্গে পড়েন হিমছড়ি বনবিট কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান শোভন। তিনি সাজ্জাদের মৃত্যুর পর তাঁর ফেইসবুক ওয়ালে লিখেছেন ‘আসেন একটু কল্পনা করি’
৩০ তারিখ সারারাত ডিউটি করে মাটি বোঝায় ডাম্পার আটক করে, বাকি কাজ সেরে গাড়ি অফিস হেফাজতে রেখে সকাল ৮ টায় ঘুমাতে গেলেন এরপর কয়েক ঘন্টা পরে উঠে ফিল্ডের জংগল কাটা, নার্সারি করা ইত্যাদি যাবতীয় কাজের তদাকরি করে ইফতার করে আবার অফিসের কাজে বসলেন, এর মাঝেই বিভিন্ন সাংবাদিক এবং সুপারিশ কারিদের সময় দিলেন, এত্তো কিছুর মাঝে রাতের খাবার সময় করতে পারেন নাই । মামলা রেডি করে, মাসিক প্রতিবেদন রেডি করে বাকি কাজ আগামীকাল সকালে করবেন চিন্তা করে অফিস থেকে ৩১ তারিখ রাত ১:৩০ টায় বের হয়ে বাসায় গেলেন। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে রাত ২:৩০ দিকে রাতের খাবার আর সেহেরি এক সাথে করে নিলেন। এমন সময় খবর পেলেন যে পাহাড় খেকোরা সেহেরির টাইমের সুযোগ নিয়ে সংরক্ষিত বন থেকে ডাম্পারে করে মাটি পাচারের জন্য কাজ শুরু করেছে। কি করবেন? যা খুশি হোক আমি আর পারবো না চিন্তা করে সারাদিনের ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন? নাকি নিজের দায়িত্ব পালনের জন্য জীবনের ঝুকি নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন দেশের বনভূমি রক্ষা করতে?
আমার খুব কাছের ছোট ভাই সহকর্মী ২০২০ সালে ফরেস্টার পদে নিয়োগ প্রাপ্ত মো. সাজ্জাদুজ্জামান সজল এত্তো কিছু করেও ক্লান্ত শরীর নিয়ে না ঘুমিয়ে রাত ৩ টার সময় বের হয়ে যান মাটি চোরদের ধরার উদ্দেশ্যে। সাথে নেওয়ার মতো লোকবলের সংখ্যাও অপ্রতুল। রাতে যদি সবাইকে নিয়ে ডিউটি তে যায় তবে সকালে নার্সারিতে আর বাগানের জংগল কাটার ডিউটি কে করবে। সেই চিন্তা করেই ড্রাইভার আলি কে নিয়ে মোটরসাইকেল যোগে বের হয়ে যান ঘটনা স্থলের উদ্দেশ্যে। যাওয়াত পথেই মাটি বোঝায় গাড়ি দেখে মোটরসাইকেল থামিয়ে গাড়িটিকে থামার সিগনাল দেন। যেহেতু গত চার রাতে চারটি গাড়ি নিজের সাহসিকতায় আটক করেছিলো তাই এবারো দাঁড়িয়ে যান পাহাড় খেকো অমানুষদের বিরুদ্ধে। হত্যাকারী চালক সরাসরি গাড়ি উঠিয়ে দেন সজলের শরীরে, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে মাথার উপর দিয়ে চাকা উঠিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়।
ঘটনা স্থলেই শেষ হয়ে যায় ৯ মাস বয়সী একটি কন্যা সন্তানের পিতার জীবন। সদ্য ২বছরের বিবাহিত স্ত্রী হয়ে গেলেন বিধবা। দুই ছেলের মাঝে একটি হারিয়ে স্কুল শিক্ষক পিতা মাতা এখন পাগল প্রায়।
সজলের বড় ভাইয়ের করা প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি। উনি নিজ হাতেই ছোট্ট ভাইয়ের থেতলানো মাথা ব্যান্ডেজ করছিলেন আর বলছিলেন আমি কি নিয়ে বাড়ি যাব, এই মুখ আমি কিভাবে দেখাবো আমার পরিবারের মানুষকে?? কারন শেষ বার দেখানোর মতো কোনো চেহারা অবশিষ্ট নেই তার ছোট ভাইয়ের।
বন বিভাগের এই মৃত্যুর মিছিল থামবে কবে? শুধু কক্সবাজারেই বিভিন্ন অভিযানে আহতদের তালিকায় আছেন অনেক বনকর্মী আর জীবন দিয়ে গেলো আমার ব্যাচে নিয়োগ প্রাপ্ত ২ জন। আগে গেছে আমার বন্ধু ইউসুফ এখন গেলো আমার ছোট ভাই সজল। এর পর কে?
বন্ধু, সহকর্মী সাজ্জাদের জন্য কামরুজ্জামান শোভর হৃদয় বিদারক লেখাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত ২৪২ জন কমেন্ট করে জড়িত পাহাড়খেকোদের বিরুদ্ধে দ্রুত শান্তি দাবি জানান। এছাড়া ঘটনার পরে গত সোমবার সকাল থেকে দেশে বিভিন্ন স্থানে বনবিট কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদের হত্যার প্রতিবাদে, পাহাড়খেকোদের শান্তি দাবি জানিয়ে প্রতিবাদ সভা অব্যাহত রয়েছে।
উখিয়ার থাইংখালীর সাবেক বনবিট কর্মকর্তা, পদুয়া চেক স্টেশনে কর্মরত মো. রাকিব হোসেন তাঁর ফেইসবুক ওয়ালে সাজ্জাদের মেয়ের উদ্দেশ্যে লিখেছেন ‘মা তুই বড় হওয়ার আগে তোর বাবাকে দুনিয়া থেকে ওরা বিধায় করে দিয়েছে,,,,,, আমি তোর বাবার সাথে ১৪ বছরের সম্পর্ক। এক সাথে ডিপ্লোমা, অনার্স, এক সাথে জব, একই রেঞ্জে চাকরি, আমি কাছ থেকে সজল কে দেখেছি। কাজের প্রতি ছিল অটুট। কোন দিন রেঞ্জ অফিসারের হুকুম না করে নাই। বন্ধু আমাদের মাফ করে দিস,,, আমি তোকে ছেড়ে চট্টগ্রাম চলে আসছি,,,কিন্তু তোকে নিয়ে আসতে পারলাম না। হত্যার বিচার হবে কিনা জানি না। তবে আর কেউ যেন এমন না হয়।
উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী মো. শফিউল আলম জানান, চাকুরী জীবনে এতো অনুগত সহকর্মী পায়নি। সাজ্জাদকে হারিয়ে বনবিভাগের অপুরনীয় ক্ষতি হয়েছে। এমনকি আমি পঙ্গু হয়ে গেছি’। তিনি আরো বলেন, দোছড়ি বনবিটে গত বছরের শেষ দিকে যোগ দেওয়ার পর থেকেই পাহাড় অধ্যুষিত উখিয়ায় পাহাড় ও বন রক্ষায় প্রায় প্রতিরাতেই অভিযান পরিচালনা করে আসছিলেন সাজ্জাদ। গত তিন মাসে দুই ডজনের মতো ডাম্পট্রাক জব্দ করে মামলার আওতায় এনে রেঞ্জ অফিসে রেখেছেন তিনি। একরাতে চারটি মাটিভর্তি ডাম্পট্রাক জব্দের ঘটনাও আছে তার। এসব কারণে তার ওপর চরম ক্ষুব্ধ ছিল পাহাড়খেকো চক্র। যার ফলশ্রুতিতে তাকে গাড়িচাপায় হত্যার শিকার হতে হয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।
কক্সবাজার সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা সমীর রঞ্জন সাহা জানান, বিট কর্মকর্তা সাজ্জাদ একজন অমায়িক সহকর্মী ছিল। সহকর্মীকে হারিয়ে তাঁর বন্ধুদের পাশাপাশি দেশজুড়ে বনকর্মীরা শোকাহত। বন রক্ষায় তাঁদের অভিযান এবং পাহাড়খেকোদের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন অব্যাহত থাকবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সারোয়ার আলম জানান, বনরক্ষা করতে গিয়ে সাজ্জাদ নিজের জীবন দিয়েছেন। তার নির্মম মৃত্যুতে আমরা একজন দক্ষ ও পরিশ্রমী বন কর্মকর্তাকে হারালাম।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, মরহুম মো. সাজ্জাদুজ্জামান সজলের ৮ বন্ধুর মধ্য কক্সবাজারের ৭ জন ও পদুয়ায় একজন কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে পদুয়ার চেক স্টেশনে মো. রাকিব হোসেন, চেন্দা বনবিটে সফিউল আলম শুভ, ছোয়ানখালী বনবিটে শামীম হোসেন, হিমছড়ি টহল ফাঁড়িতে মো. কামরুজ্জামান শোভন, রাজাকুল বনবিটে জহিরুল আলম, শাপলাপুর বনবিটে মো. সোহেল রানা, থাইংখালী বনবিটে বিকাশ দাশ, কক্সবাজার রেঞ্জ এ ক্যাচিংউ মারমা, মনখালী বনবিটে শিমুল কান্তি নাথ।
এদিকে বনবিট কর্মকর্তা সাজ্জাদের হত্যার প্রতিবাদে মঙ্গলবার দুপুরে কক্সবাজারে প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধনের আয়োজন করেন বনকর্মী-কর্মকর্তারাগণ। বনকর্মকর্তা -কর্মচারী ছাড়াও বিভিন্ন পেশার লোকজন এই প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে পাহাড়খেকোদের ডাম্পট্রাকের চাপায় বনবিট কর্মকর্তা নিহতের ঘটনায় ১০ জনের নাম উল্লেখ করে ১৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। এ ঘটনায় এজাহারভুক্ত এক আসামিকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। সোমবার (১ এপ্রিল) বিকেলে বনবিভাগের উখিয়ার রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী শফিউল আলম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন বলে জানিয়েছেন উখিয়া থানার ওসি মো. শামীম হোসেন।
হত্যা মামলার আসামিরা হলেন, উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের পশ্চিম হরিণমারা এলাকার মোহাম্মদ কাশেমের ছেলে ও ডাম্পট্রাকটির চালক মো. বাপ্পী (২৩), একই এলাকার সুলতান আহম্মদের ছেলে ছৈয়দ আলম ওরফে কানা ছৈয়দ (৪০) ও তার ছেলে মো. তারেক (২০), রাজাপালং ইউনিয়নের তুতুরবিল এলাকার নুরুল আলম মাইজ্জার ছেলে হেলাল উদ্দিন (২৭), হরিণমারা এলাকার মৃত আব্দুল আজিজের ছেলে ছৈয়দ করিম (৩৫), একই এলাকার আব্দুল আজিজের ছেলে আনোয়ার ইসলাম (৩৫), আব্দুর রহিমের ছেলে শাহ আলম (৩৫), হিজলিয়া এলাকার ঠান্ডা মিয়ার ছেলে মো. বাবুল (৫০), একই এলাকার ফরিদ আলম ওরফে ফরিদ ড্রাইভারের ছেলে মো. রুবেল (২৪) এবং হরিণমারা এলাকার শাহ আলমের ছেলে কামাল উদ্দিন ড্রাইভার (৩৯)।
মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ৫-৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন এজাহারভুক্ত ৫ নম্বর আসামি ছৈয়দ করিম (৩৫)।
রোববার ভোর সাড়ে ৩টার দিকে উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের হরিণমারা এলাকায় পাহাড় কেটে মাটি পাচার করছিলেন একদল পাহাড়খেকো। খবর পেয়ে বনবিভাগের দোছড়ি বিটের কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুজ্জামান সজলসহ (৩০) কয়েকজন বনকর্মী ঘটনাস্থলে যান। এসময় তিনিসহ মোটরসাইকেল আরোহী দুইজনকে পাচারকারীদের মাটিভর্তি ডাম্পট্রাক চাপা দেয়। এতে সাজ্জাদুজ্জামান ঘটনাস্থলে মারা যান এবং মোহাম্মদ আলী নামের এক বনরক্ষী আহত হন।
নিহত সাজ্জাদুজ্জামান সজল (৩০) কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের উখিয়া রেঞ্জের দোছড়ি বনবিটের বিট কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার মোহাম্মদ শাহজাহানের ছেলে। ঘটনায় আহত বনরক্ষী মোহাম্মদ আলী (২৭) টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের ঝিমংখালী এলাকার আবুল মঞ্জুরের ছেলে।
ওসি শামীম হোসেন বলেন, রোববার রাতে বনবিভাগের উখিয়া রেঞ্জের এক কর্মকর্তা নিহতের ঘটনায় রেঞ্জার বাদী হয়ে ১০ জনের নাম উল্লেখসহ ১৫ জনকে আসামি করে থানায় এজাহার দায়ের করেন। পরে পুলিশ মামলাটি নথিভুক্ত করে।
ঘটনার পর থেকে পুলিশ জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারে অভিযান শুরু করেছে। সোমবার ভোরে রাজাপালং ইউনিয়নের হরিণমারা এলাকায় অভিযান চালিয়ে এজাহারভুক্ত ৫ নম্বর আসামি ছৈয়দ করিমকে গ্রেফতার করা হয়।মামলার অপর আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ওসি।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।