এই আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচার শুরুর পর ২০১০ সাল থেকে তাদের আইনজীবীরা প্রধান যে কৌশল অবলম্বন করেন তা হলো বিচারের প্রতিটি পর্বে যতটা সম্ভব বিলম্ব করা। প্রথম দুই বছর তারা এ কৌশল কাজে লাগাতে পারলেও সাক্ষী শুরুর স্তরে তারা আর সফল হতে পারেনি। বরং নিজেদের পাতা জালে পড়ে হারাতে হয়েছে প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাককে।
একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, ধর্মান্তরকরণ, দেশান্তরসহ মানবতাবিরোধী নানা অপরাধের অভিযোগের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়ে এ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। দুটি ট্রাইব্যুনাল বিচারকাজ পরিচালনা করছেন। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ প্রথম ট্রাইব্যুনাল এবং ২০১২ সালে ২২ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। এখন পর্যন্ত মোট ১৭টি মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে। গোলাম আযম ও আব্দুল আলীম আপিল করা অবস্থায় ও এ কে এম ইউসুফ বিচার চলাকালে মারা যান।
পাঁচ বছর আগে বিচার শুরুর সময় আটককৃত জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রধান নেতাদের জামিন হবে না জেনেও জামিন আবেদন, জামিনের শুনানি, জামিন না-মঞ্জুর আদেশের রিভিউ-এর একের পর এক আবেদনে সময় কাটাতে থাকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এমনকি দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ৪৮ দিন জেরা করেছেন তারা।
কেবল ট্রাইব্যুনালে নয়, ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়গুলোর ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টে যেসব আপিল হয়েছে, তাতেও আসামিপক্ষ সময়ক্ষেপণের কৌশল নিয়েছে বারবার। ২০১৩ সালের থেকে হরতালের অজুহাত দেখিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী আদালতে আসেন না। তাদের অনুপস্থিতিতে শুনানিও হয় না। এছাড়া কখনও কখনও সাজাপ্রাপ্তের আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার ক্ষেত্রেও কৌশলে সময় নিয়েছে। ৯ মে ২০১৩ ট্রাইব্যুনাল-২ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার পরও আপিল নিষ্পতি হতে সময় লেগেছে দেড় বছরের বেশি। এমনকি চূড়ান্ত রায়ের পর এখন রিভিউ শুনানির জন্য নানা কায়দায় আইনজীবীরা সময় নিয়ে চলেছেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আপিল নিষ্পত্তির বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, তারা শুরু থেকেই নানা অপকৌশলের সাহায্য নিয়েছে। এমনকি শুনানি করতেও ইচ্ছে করে বিলম্ব করেছে, কারণ তাদের ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসতে না পারলেই এসব মামলা থাকবে না।
জামায়াত নেতাদের পক্ষে আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, ‘সময়ক্ষেপণের অভিযোগ সত্য নয়। তারা যখন যেভাবে যা চেয়েছে সেভাবেই তো হচ্ছে। ন্যায়বিচারের পক্ষে কথা বললে তাড়াহুড়োর সুযোগ নেই। আপিল বিভাগে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সারসংক্ষেপ জমা দিতে যে সময় দরকার হয়, তারচেয়ে অনেক কম সময় পাচ্ছি আমরা। তিনি আরও বলেন, হরতালের দিনে সাধারণত সুপ্রিমকার্টে বিচারকাজ পরিচালিত হয় না। তাই হরতালের দিনে আদালতে না যাওয়াকে সময়ক্ষেপণ বলার সুযোগ নেই।
এদিকে এ কৌশলের প্রধান কুশলী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পর থেকে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তিনি কোথায় গেছেন, কেন দেশে ফেরেন না বা কবে নাগাদ ফিরবেন এসব নিয়ে দলটির পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। দেশত্যাগের একমাস পর জামায়াত নেতাদের আইনজীবী দলের সদস্য তাজুল ইসলাম জানান, তিনি দেশে ফিরতে চাইলেও পারছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জুনিয়র আইনজীবী বলেন, তার নামেও মামলা হতে পারে সেই আশঙ্কা থেকে তিনি দেশের বাইরে চলে গেছেন। তবে, ব্যারিস্টার রাজ্জাক চলে যাওয়ার পর তার অনুপস্থিতিকেও ব্যবহার করে কিছু সময়ক্ষেপণ করতে চেয়েছে জামায়াতের আইনজীবী প্যানেল। মাস দুয়েকের জন্য তাতে সমর্থ হলেও পরে আর এ কৌশল টেকেনি।
বিলম্ব কৌশলের পাশাপাশি টাকার খেলাও খেলার চেষ্টা করেছে আটক জামায়াত নেতারা। ২০১৩ সালের এপ্রিলে সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাসেম আলী মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ প্রশ্নবিদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি লবিস্ট প্রতিষ্ঠানকে আড়াই কোটি ডলার দিয়েছেন, যার তথ্য-প্রমাণ সরকারের হাতে আছে।
শুরু থেকেই মার্কিন প্রশাসনকে প্রভাবিত করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে জামায়াতের পক্ষে সমর্থন বাড়াতে কাজ করে গেছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারাধীন মীর কাসেম আলীর ভাই মীর মাসুম আলী ও আরেক জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে নাকীবুর রহমান নিজামী। তাদের সৃষ্ট সংগঠন ‘অর্গানাইজেশন ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস’ এবং ‘হিউম্যান রাইটস ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা চালালেও শেষ রক্ষা হয়নি।
বিচার বিলম্বে নেওয়া ২০ দলীয় জোটের নানা কৌশল নিয়ে প্রসিকিউটর শাহীদুর রহমান বলেন, ‘তাদের নানাবিধ কৌশলেই এই বিচার চল্লিশ বছর পিছিয়ে গিয়েছিল। সেটাও যেমন সফল হয়নি, বিচার শুরুর পর তারা যত ছক এঁকেছেন সেগুলোও সফল হয়নি। কারণ এই বিচার বাংলাদেশের জনগণের দাবি।’
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।