কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে কোনও নিয়মনীতিই যেন নেই। যে যার ইচ্ছেমতো ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে-আসছে। এরইমধ্যে জেলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। কারও কাছে নেই কোনও জবাবদিহিতা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও এ ব্যাপারে অনেকটা নিষ্ক্রিয়।
দেশ ছেড়ে আসা রোহিঙ্গারা এখন জীবন চালাতে ক্যাম্পগুলোর আশপাশে নতুন তৎপরতা চালাচ্ছে। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের দু’পাশ ধরে জটলা বেঁধে ভিক্ষার আশায় বসে থাকছে তারা। উপোস থাকতে থাকতে ভিক্ষার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে বলে জানিয়েছে তারা।
কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে উখিয়া উপজেলার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। কক্সবাজার-টেকনাফ আরাকান সড়কের পশ্চিম পাশেই এই শিবিরের অবস্থান। প্রায় ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে বালুখালী এলাকায় নতুন করে গড়ে উঠেছে আরও একটি অনিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্প। এই কুতুপালং ও বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ছাড়াও টেকনাফ উপজেলার নয়াপাড়া, লেদা ও শামলাপুরেও রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প রয়েছে। এসব ক্যাম্পে নিবন্ধিত ৩২ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। এছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনিবন্ধিত রয়েছে আরও প্রায় সাড়ে ৪ লাখ রোহিঙ্গা। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, গত অক্টোবর থেকে নতুন করে ৭০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী এসব এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে।
এসব রোহিঙ্গার অবস্থা জানতে গত ১০ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করা হয় । ক্যাম্পে পৌঁছার আগেই অর্থাৎ কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সড়কের পাশে একটু পর পর জটলা বেঁধে বসে আছে রোহিঙ্গারা। সড়কে চলাচলরত প্রতিটি গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছে তারা। গাড়ি থামালেই হামলে পড়ে টাকা-পয়সা সাহায্য পাওয়ার আশায়।
মিয়ানমারের মংডু উপজেলার কিয়ারিপাড়া, নাপ্পুরা ও থামিল এলাকা থেকে এসেছেন রোহিঙ্গা নারী রশিদা খাতুন (৫৫), শফিকা বেগম (৬০), মরিয়ম খাতুন (৭৫) ও জহুরা বেগম (৪৫)। এদের কেউ এক সপ্তাহ, আবার ১৫দিন আগে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে এসেছেন। কিন্তু ক্যাম্পে এসেই ঘটে বিপত্তি। মাসে ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা পর্যন্ত ঝুঁপড়ি ঘরের ভাড়া এবং পেঠের ক্ষুধা মেটাতে তাদের বাধ্য হয়েই রাস্তায় নামতে হয়েছে।
শুধু রশিদা-শফিকা নয়, তাদের মতো একাধিক নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিবেদকের। তারা বলেছেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার সময় কিছু্ই নিয়ে আসতে পারেননি তারা। যা নিয়ে এসেছিলেন সেই সম্বলটুকুও ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। ক্যাম্পে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো সামান্য ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করলেও কেউ পাচ্ছে, আবার কেউ খালি হাতে ফেরত যাচ্ছে। তাই দীর্ঘদিন উপোস থাকতে হচ্ছে তাদের। এক বেলা খেলে দুই বেলা খেতে পারছেন না। এছাড়াও ক্যাম্পের ঝুঁপড়ি ঘরের ভাড়া মেটাতে বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমেছেন তারা।
কুতুপালং ক্যাম্পমুখী রাস্তায় আরও কিছু দূর গিয়ে দেখা যায়, নারী-পুরুষের পাশাপাশি শিশুরাও সারিবদ্ধভাবে রাস্তার দুই পাশে বসে রয়েছে ভিক্ষায় আশায়। মিয়ানমারের মংডু উপজেলার চালিপারাং গ্রাম থেকে এসেছেন সৈয়দ হোসেন (৫০)। তার দুই ভাই ও এক মেয়েকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নির্যাতন করে হত্যা করেছে। তাই তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। সৈয়দ হোসেনের মতো মিয়ানমারের সেনাদের নির্যাতনের বর্ণনা শুনিয়েছেন একই এলাকার আব্দুল জব্বার, হামিদুল হক ও ফরিদ মিয়া। ৮ বছরের শিশু আবু তাহের, মুনাফ ও ছলিম উল্লাহও ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন এই প্রতিবেদককে। তাদের কেউ বাবাকে আবার কেউ মাকে হারিয়ে কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন জীবন বাঁচাতে বাধ্য হচ্ছেন ভিক্ষা করতে। কোনও সময় দিনে ১শ’ থেকে ২শ’ টাকা মিললেও অনেক সময় এক টাকাও জোটে না বলে জানান তারা।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গারা রাস্তায় ভিক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে ভিক্ষাও পাবে না। তখন সড়ক ডাকাতির মতো পরিস্থিতির শিকার হতে হবে আমাদের। ইতোমধ্যে এলাকায় চুরি-ডাকাতি বেড়ে গেছে। তাই আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতায় যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দিতে সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।’
এ বিষয়ে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কড়া নির্দেশনা রয়েছে যে রোহিঙ্গারা যাতে করে নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যেতে না পারে। সে অনুযায়ী গত এক সপ্তাহ ধরে আমিসহ উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে উখিয়া থানার পুলিশ ক্যাম্প এবং আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করে রোহিঙ্গাদের নিষেধ করছি। বিশেষ করে রাস্তার পাশে ভিক্ষাবৃত্তি না করতে কড়া ভাষায় নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।’
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের ৯ তারিখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এলাকায় সন্ত্রাসীদের সমন্বিত হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর এর দায় চাপানো হয় রোহিঙ্গাদের ওপর। আর তখন থেকেই শুরু হয় সেনাবাহিনীর দমন প্রক্রিয়া। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি, এরপর থেকেই রাখাইন রাজ্যে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। জাতিসংঘ এরইমধ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জাতিগতভাবে নির্মূল করার অভিযোগ এনেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা নারীদের গণধর্ষণ, নানা নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তোলা হয়। কিন্তু এরপরও হাজার হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এই পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। বাংলা ট্রিবিউন
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।