শিক্ষক জন্মায়, সৃষ্টি হয় না..মহিউদ্দিন স্যারও জন্মেছিলেন, ষোলকলায় শিক্ষক হয়ে,পৃথিবীতে উনার আগমন রাত্রিকালীন মেহমান বেশে..
রাতের মেহমানের সাক্ষাৎ সবাইর মেলে না,কেউ দেখে কেউ দেখেও না।যারা পেয়েছে তাদের বুকে বুকেই উনার স্মৃতি চিহ্ন,এদিক বিচারে পৃথিবীর মানুষ আজ দুভাগে বিভক্ত, এক,–যারা পেয়েছে দুই–যারা পায়নি।
পারিবারিক এক দুর্দশাগ্রস্ত সময়ে বাবা আমার ছোট ভাই শাহজান মাহমুদ আর আমাকে মরিচ্যা হাইস্কুলের পাশাপাশি বাড়িতে লজিং মাষ্টার নিয়োগ করে,আমি অষ্টম, শাহজান ৭ম শ্রেণিতে,পালং হাইস্কুল থেকে নিয়ে মরিচ্যা হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন।
মহিউদ্দিন স্যারের সাথে পরিচয় করিয়ে বলেন,উনি আমার মামু মাম্মার চাচাত ভাই।উনার হাতে তোদের পড়ালেখার দায়িত্ব দিয়ে গেলাম, উনার কাছে প্রাইভেট পড়বি।
তোদের মা অসুস্থতায় আমার চাকুরীর কারনে তোদের আমার সাথে রেখে পড়ালেখা করানো অসম্ভব,। আমি মাঝে মধ্যে তোদের দেখে যাব।এর চেয়ে বেশী কোন সুযোগইই আমার কাছে প্রত্যাশা রাখবি না।আমি অসহায়।
এই অবলম্ভন থেকে পড়ালেখা পারলে করবি নইলে তোরা দুইভাইকে গাড়ীর গেরেজে মেকানিকের হেলপার দেয়ার কর্মটিই আমার সামর্থ্যে অবশিষ্ট আছে।
মহিউদ্দিন স্যারের সকালের ব্যাচে আমরা দুভাই রিগুলার ছাত্র বনে গেলাম।ইংরেজি গ্রামার থেকে অংক সব বিষিয়ে উনার দেখভাল, সাথে আউট বই পড়তে তালিম দিতেন,বড় বড় কিছু বই ও পড়তে দিতেন।
সবাইকে পেপার পড়তে উতসাহ যোগাতেন। যারা উনার প্রাইভেট ছাত্র তাদেরকে কিছু পুরাতন পেপার দিয়ে বলতেন “এইটা পড়ে আসবি কোনটা তোর ভাল লেগেছে আমারে কাল অথবা পরসুদিন বলতে হবে।
সেইসময় ঢাকা থেকে জাতীয় দৈনিকগুলো দুদিন, আড়াইদিন, কোন সময় তিনদিন পর এ জনপদে পোঁছাত।তখন ইত্তেফাক, সংবাদ ছিল খুবিই জনপ্রিয় পত্রিকা।
স্যার, আরো এক,দুদিন পর এগুলো এনে কেটে কেটে একেকজনকে একেকটা টপিকস ধরিয়ে দিতেন।যারা টপিকস বলতে পারবে না,না পারাদের জরিমানা চাউল, মুরগী এনে দিতে হতো,।
স্যার পেয়াজ, মরিচ, তৈল,হলুদ সব যোগাড় করে নিজ হাতে রান্না করে নিজ হাতে খাওয়াতেন।ওইদিন পিকনিক,পিকনিক আনন্দ হত প্রাইভেটে।
পেপার পড়ানোর উনার এই কোতুহল দেখে আমি একদিন স্যারকে জানতে চেয়েছিলাম “স্যার পেপার পড়ে কি লাভ?এগুলো তো সীলেবাসেও নেই পরীক্ষায় ও আসে না।আর পেপারে থাকে সব মারামারির খবর।
স্যার পেপার পড়ার লাভ বুঝিয়েছিলেন এভাবে,”মারামারি হয়েছে এটা জানাই হচ্ছে লাভ।তখন মরম বুঝিনি..আজ যখন পেপার হাতেনি শুধু মহিউদ্দিন স্যারের পা,ছুয়ে প্রণাম করে কৃতজ্ঞতা জানাতে ইচ্ছে হয়।
১৯৮২সাল।মহিউদ্দিন স্যার সিদ্ধান্ত নিলেন নাটক করব।সিলেকশন করলেন ‘কবরের কান্না ‘ঐতিহাসিক নাটকটি মঞ্চায়ন করবেন।ছাত্র শিক্ষক মিলে সব চরিত্র রিয়েছাল শুরু করে দিলেন।
নায়িকা বানানো হল আমাকে।,দলিলকে দেয়া হল অন্য মহিলা চরিত্র।আমার নাম ছিল ‘মেহের’ ওর নাম ছিল ‘সালমা’।তখনকার সময়ে মেয়েদের এরকম অনুষ্টানে অংশগ্রহনে ছিল সামাজিক বাধা।
মৃদুলস্যার ছিলেন,নাটকের বিসসমিত্র,মহিউদ্দিন স্যার শের আফগান, মোহাব্বত খা ছিলেন সৈয়দ আলম,জাহাংগীর ছিলেন মোহাম্মদ হোসেন বড়বিল।আরো অনেকের অংশগ্রহনে হয়েছিল মঞ্চ নাটকটি।সাড়া ফেলেছিল গেরামে।হাজার দর্শকের দৃষ্টি নন্দন সাড়া।
শ্রুতিলিপি লিখাতেন।আজ প্রজন্মের বানান ভুলের চিত্রদেখলে ‘মহিউদ্দিন স্যারকে কোর্টবাজার দরগামোরা কবরস্থান থেকে তুলে পায়ে চুমো দিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়”অ মহিউদ্দিন স্যার আমাদের ক্ষমা করো,আমরা আপনার দান গ্রহন করতে জানিনে।
স্কুলে যে সব ছাত্র ভাল রেজাল করার সম্ভবনা,ওদেরকে কোর্টবাজার মাতব্বর পাড়ার উনার কাছারিঘরে নিয়ে হোষ্টলের মত করে পড়াতেন ছাত্ররা খাওনবাবদ কিছু দিলেও নিতেন,না দিলেও কোনদিন কিছুই বলতেন না।নিজ নির্বাহে চালিয়ে নিতেন।
গরীব ছাত্রদের কাছে দিলেও নিতেন না।ফিরিয়ে দিয়ে বলতেন,আমি অসুস্থ হলে এই টাকা গাড়ী ভাড়া দিয়ে আমারে দেখতে আইছ,মনে রাইছ,এই টাকা তোর কাছে জমা রেখেছিলাম।
স্যারের কাছারিঘরে আমারো জায়গা হয়েছিল।প্রতিভা কার কোথায় উনার বের করে আনার কোশলের কাছে গরীবের ছেলেরা ন্যুব্জ।
বিতর্ক,সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করিয়ে কথা বলিয়েই ছাড়তেন।আজ দাড়িয়ে কথা বলার শক্তি তিনি শিখিয়েছিলেন।
যখন কথা বলতে দাড়াবি।তুইছাড়া যা আছে কেউ কিছু জানে ভাববি না,আমি থাকলেও না।সবাইরে কাঠখড়ি ভাববি,তুই ইএকজন মানুষ আছস ভাবনায় রাখবি,নইলে হঠাত কথা বন্ধ হয়ে যাবে।আজো ভুলিনি স্যারের এই সবক।
বলখেলার টিম হত a,b,c,d,এইনামে।আবার কখনো ফুলের নামে। স্যার যে সব ছাত্ররা খেলার মাঠে আসতে চাইতেন না তাদের অন্যছাত্রদের দিয়ে ধরে এনে ফিল্ডের কির্দমাক্ত স্তানে এনে ফেলে কর্দমাক্ত করার ইশারা দিতেন, এরপর তারে খেলিয়েই ছাড়তেন।
স্যার রেফারী থাকতেন।আমারে ও একবার এমন কর্দমাক্তমাটিতে ফেলে ফুটবলে নামিয়েছিলেন।
রত্নাপালং মাতবর বংশের উত্তরাধিকারী ছিলেন।উনার বাবার নাম..আনুমিয়া চোধুরী…………….মাতা………………..বড়মহেশখালী নিবাসী আমির মিয়া স্যারের মেয়ে…সাবেকূন নাহারের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন।…একপুত্র মকছুদ।বাকীরা কন্যা।
প্রথমজীবনে স্যার বৈমানিক হবার পরীক্ষায় নির্বাচিত হন।মা,বাবার এককথা আমার ছেলে মারা যাবে বিমানে।অনুমতি মিলেনি যাবার।এরপর তিনি শিক্ষকতায় হাতেখড়ি নেন।
সোনার পাড়া হাইস্কুল, হ্নীলা হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হয়ে যোগদান করেছিলেন।মরিচ্যা হাইস্কুলের মায়া ছিল ওনার অস্তি,মজ্জায়,।তাই ওনি ফিরে এসেছিলেন মরিচ্যার মাটি ও মানুষের টানে।জীবনের শেষদিন পর্যন্ত গরীবের ছেলেমেয়ের মংগলে মংগলেই কাটিয়েছেন জীবন।
উনার শব দেহটি মাটিতে কবরস্ত করার পর উনার এক ছাত্র জিতেন্দ্র বড়ুয়া( বর্তমানে মরিচ্যা হাইস্কুলে র শিক্ষক) বিলাপ করে কান্নায় আকাশ বাতাস কেপেছে।দরগামোরা কবরস্থান থেকে উনাকে নামিয়ে আনতে হিমসিমে পড়েছিল মুরুব্বীরা।
একঝাক ছাত্রছাত্রীর এরুপ ভালবাসায় সিক্ত হয়ে বিদায় হইল আমাদেরই মহিউদ্দিন স্যার…পৃথিবীতে আমরা আছি এখনো.. “আপনার ভালবাসার অতন্দ্র প্রহরী হয়ে”…
লেখক:—উখিয়া কলেজের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক। #০১৭৪০৫৪৫০৩৫
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।