২৪ নভেম্বর, ২০২৪ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২১ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬


শিরোনাম
  ●  মাকে হত্যার পর থানায় ছেলের আত্মসমর্পণ।   ●  মারমেইড বীচ রিসোর্টে বালিয়াড়ি দখল করে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান   ●  যারা খেলাধূলা করছে, তারা বিএনপির শক্তিকে অনুধাবন করতে পারছে না   ●  উখিয়ার নতুন ইউএনও কামরুল হাসান চৌধুরী   ●  উখিয়ায় যৌথবাহিনীর অভিযানে শক্তিশালী গ্রেনেড উদ্ধার   ●  ছয় কোটি তরুণের দেয়াল লিখন বাংলাদেশের নতুন সংবিধান   ●  চকরিয়ায় ২টি ডাম্পার ট্রাক ও এক্সকেভেটর জব্দ   ●  ধরে নিয়ে যাওয়া ২০ বাংলাদেশী  জেলেকে ফেরত দিল আরাকান আর্মি   ●  মেরিন ড্রাইভে ইয়াবাসহ নারী আটক   ●  সড়ক দখল করে নৈরাজ্য সৃষ্টি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়ার অভিযোগে কক্সবাজারে আ.লীগের ৯১ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা

মাতামুহুরীর পানি বিপদ সীমার ৫ফুট উপরে, ভেঙ্গে গেছে শহর রক্ষা বাধ

Chakaria  Picture  25-06-2

কক্সবাজারের চকরিয়ায় টানা চারদিনের ভারিবর্ষণে ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি মাতামুহুরী নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। চার শতাধিক গ্রামের প্রায় ১০ হাজার পরিবারের চার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গ্রামীন সড়ক গুলো পানির নিচে তলিয়ে গেছে। অসংখ্য শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। বর্তমানে মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার পাঁচ ফুট উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। হুমকির মধ্যে রয়েছে পৌরশহর রক্ষার বাধ। গতকাল রাতে ৭টার থেকে ৮নং ওয়ার্ডের পাউবোর ১নং গাইড বাধটি ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম দেখা দিয়েছে। যে কোন মুহুর্তে পুরো পৌরশহরটি পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। বেড়িবাধ ভেঙ্গে গিয়ে উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৪০হাজার একর চিংড়ি ঘের পানির সাথে একাকার হয়ে গেছে। প্রায় ২৫হাজার একর জমির আমন বীজতলা, ফুলবাগান ও ক্ষিরা (শষা) সহ সবজি ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। দুই তীরের জানমাল রক্ষায় উপজেলা প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য উদ্ধার তৎপরতাও দেখা যাচ্ছে না। চিরিঙ্গা-মানিকপুর সড়ক, চিরিঙ্গা-বেতুয়াবাজার সড়ক ও বানিয়ারছড়া পেকুয়া সড়ক বেশীরভাগ এলাকা পানির নিচে চলে গেছে। পানিতে নিমজ্জিত থাকায় উপজেলা সদরের সাথে অধিকাংশ ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। চকরিয়া পৌরসভার দুই নম্বর ওয়ার্ডের হালকাকারা এলাকায় পৌরশহর রক্ষাবাঁধ ভেঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর থেকে পৌরসভার বিভিন্ন এলাকার জনবসতি অন্তত ৭ ফুট পানির নীচে তলিয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ার খবর পেয়ে চকরিয়া পৌরসভা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম জনগনের সহায়তায় সাড়ে ৭শত মাটির বস্তা ও আড়াইশত গাছের স্পার দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ ওই বেড়িবাঁেধর অংশটি দীর্ঘ চারঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে জোড়া লাগাতে সক্ষম হন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গত চারদিনের ভারিবর্ষনে ও মাতামুহুরী নদী দিয়ে প্রবাহিত বানের পানিতে উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন, কাকারা ইউনিয়নের মধ্যম কাকারা, শাকের মো:চর, মিনিবাজার, ফাসিয়াখালীর দিগরপানখালী, খোয়াজনগর, পৌরএলাকার, কোচপাড়া, ভাঙ্গারমুখ, নামার চিরিঙ্গা, হালকাকারা, জেলেপাড়া, চরপাড়া, কাজীরপাড়া, ফুলতলি, সবুজবাগ, হাসপাতাল সড়ক, বাটাখালী, সেনাক্যাম্প, করাইয়াঘোনা, এলাকার নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় বানের পানি বসতবাড়িতে ঢুকে পড়ায় প্রায় ১০হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পৌরশহর রক্ষাবাধের বিভিন্ন পয়েন্টে ভেঙ্গে গিয়ে ও জেলেপাড়া এলাকায় খোলা স্লুইচ গেইট দিয়ে এবং কোচপাড়া পাউবোর ১নং গাইড ভেঙ্গে গিয়ে বন্যার পানি ঢুকে ওইসব এলাকায় প্লাবিত হয়েছে। নদীর তীরবর্তী ছিকলঘাট উত্তর লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিলের খিলছাদক, খোজাখালী এলাকার নিম্মাঞ্চল পানিতে প্লাবিত হয়ে ঘর-বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। গভীর রাত পযর্ন্ত বেড়িবাধ রক্ষা কাজ অব্যাহত রেখেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
এদিকে বাঘগুজারা রাবার ড্যাম ও কোনাখালী পুরুত্যাখালী পয়েন্টে বেড়িবাধ ভেঙ্গে বানের পানি ঢুকে পড়েছে পহরচাদা, বাঘগুজারা, কোনাখালী, বিএমচর, বাংলাবাজার, পুরুত্যাখালী, ঢেমুশিয়া, পূর্ববড়ভেওলা, পশ্চিমবড়ভেওলা, বদরখালী ও সাহারবিল এলাকায়। এসব এলাকার অসংখ্য ঘর-বাড়ি শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গ্রামীণ সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পালাকাটা রাবার ড্যামের বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে গিয়ে সাহারবিল ও চিরিঙ্গা ইউনিয়নের রামপুর, চরণদ্বীপ, সওদাগরঘোনা, বুড়িপুকুর এলাকার ৪০হাজার একর চিংড়িঘের পানির সাথে মিশে গেছে। অভিযোগ উঠেছে, পালাকাটা রাবার ড্যামের ৩টি রাবার ব্যাগ বন্ধ না করায় নদীর পানির শ্রেুাত চিরিংগা ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকায় ঢুকে ভয়াবহ প্লাবিত হয়েছে।
ঢেমুশিয়ার বাসিন্দা আতাউল করিম জুয়েল ও মো: ওমর আলী জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুইচ গেইট গুলো বন্ধ থাকাতে বানের পানিতে প্লাবিত হয়েছে শতশত একর চিংড়িঘের। বর্তমানে ঢেমুশিয়া অধিকাংশ এলাকার পানির নিচে রয়েছে। শত শত পরিবার তাদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে। তবে খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
মানিকপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা হামিদ হোসেন জানান, মানিকপুরে এবারের বন্যা অত্যান্ত ভয়াবহ। বানের পানিতে মানিকপুর গ্রামের প্রায় ৫’শ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বাড়ি-ঘরে ঢুকে পড়েছে পানি। অনেক পরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন স্কুল, মাদ্রাসা ও নিরাপদ জায়গায়। তিনি আরও বলেন, পানিতে ভেসে গেছে অনেক গবাদী পশু। তলিয়ে গেছে সুরাজপুর- মানিকপুরের আভ্যন্তরিন সড়ক।
পৌর এলাকার হালকাকারার বাসিন্দা ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি ফজলুল করিম সাঈদী জানান, পৌরশহরের ২নং ওয়ার্ডের শহর রক্ষা বাধের বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে হালকাকারা, জেলে পাড়া সওদাগর পাড়া, চরপাড়া, কাজীরপাড়া পানি ঢুকে পড়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অন্তত ২০হাজার মানুষ। তিনি অভিলম্বে তাদের উদ্ধারে প্রশাসনের সহযোগিতার আহবান জানান।
অপরদিকে হারবাং ও বরইতলী ছড়াখালের পানিতে প্লাবিত হয়ে পহরচাদা ডেইঙ্গাকাটা উত্তর বরইতলী, দক্ষিণ বরইতলী, হারবাং ইউনিয়নের নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হয়ে অসংখ্য ঘর-বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। পানি বন্দী হয়ে পড়েছে দুই ইউনিয়নের ৫০হাজার মানুষ। ওই দুই ইউনিয়নের প্রায় ৫হাজার একর সবজি ক্ষেত ও বরইতলী ইউনিয়নের শতাধিক গোলাপ বাগান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তাছাড়া ডুলাহাজারা বালুরচর এলাকায় বেড়িবাধ ভেঙ্গে পুরো ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে গেছে। এছাড়া খুটাখালী অফিস এলাকায় একটি কালভাট থেকে সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পানি ঢুকে পড়ায় খুটাখালী ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে দুই ইউনিয়নের ৪০হাজার মানুষ।
কৈয়ারবিলের জাফর আলম সিকদার ও মাওলানা আবুল হাসেম জানান, ৪দিনের বৃষ্টিতে কৈয়ারবেল বড় ধরণের কোন ক্ষতি না হলেও গতকাল সকাল ৬টা থেকে উজান থেকে নেমে আসা মাতামুহুরী নদীতে পানি অধিকতর বেড়ে যাওয়ায় কৈয়ারবিল ও পাশ্ববর্তী লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা ৭/৮ফুট পানির নীচে রয়েছে। কৈয়ারবিল বানিয়ারকুম, পরিষদ, মুহুরীপাড়া, খোজাখালী, ফকিরাহাটখোলা, স্কুল এলাকা ও লক্ষ্যারচরে মন্ডলপাড়া, হাজী পাড়া, রুস্তমআলী চৌধুরীপাড়া, ছিকলঘাট, জিদ্দাবাজার চরপাড়া সহ বেশ কিছু এলাকা বানের পানিতে প্লাবিত হয়ে দু ইউনিয়নের অন্তত ২০হাজার নারী পুরুষ পানি বন্দী রয়েছে। এসব ইউনিয়নে ঘেরের মাছ, বীজতলা, সবজি ক্ষেত সহ সব কিছু পানিতে তলিয়েগেছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে কোন সহায়তাও প্রশাসনের পক্ষ থেকে যায়নি।
ওইসব এলাকায় বৃস্পতিবার সকালে উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সাহেদুল ইসলাম, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় বালির বস্তা দিয়ে ভাঙ্গন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেন। চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আলম জানান, দূর্গতদের জন্য এপর্যন্ত উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫হাজার কেজি চিড়া ও ৬’শ কেজি গুড় বিতরণ করা হয়েছে। তিনি পুরো উপজেলায় বন্যা দূর্গতদের সহায়তায় সরকার সহ দেশি-বিদেশী এনজিও সংস্থাকে এগিয়ে আসার আহবান জানান এবং তার ব্যক্তিগত ও উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত রাখার ঘোষষা দেন।
ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী জানান, তার ইউনিয়নের ঘুনিয়া এলাকায় সম্প্রতি নির্মিত বেড়িবাধ ভেঙ্গে ঘুনিয়া, রাজারবিল, নয়াপাড়া, নিজপানখালী সহ বেশ কিছু এলাকায় বানের পানি ঢুকে পড়েছে। এসব এলাকায় শতশত ঘর-বাড়ি পানি বন্দী হয়ে পড়েছে। চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলহাজ্ব নুরুল ইসলাম হায়দারের বরাত দিয়ে পৌর সচিব মাসউদ মোর্শেদ জানান, পৌর এলাকার কোচপাড়া,মাষ্টারপাড়া, নামার চিরিংগা ও ষ্টেশনপাড়া এলাকা হয়ে বেড়িবাধ ভেঙ্গে বানের পানি ঢুকার আশঙ্কায় সকাল থেকে এক হাজার বস্তা বালু এসব পয়েন্টে দেওয়া হয়েছে। শহর রক্ষাবাধ ভাঙ্গন প্রতিরোধে সার্বক্ষনিকভাবে তদারকি করা হচ্ছে। উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সহ যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। তিনি জানান, বন্যা কবলিত এলাকায় পৌর মেয়র প্রাথমিকভাবে ১২জন পুরুষ ও নারী কাউন্সিলরদের মাধ্যমে প্রতিজনকে ১০হাজার টাকার করে ১লাখ ২০হাজার টাকার পরিমাণের চিড়া ও গুড় প্রদাণ করেছেন।
এদিকে প্রশাসন সহ সর্বস্তরের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বন্যা দূর্গত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তায় এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন চকরিয়া পেকুয়া উন্নয়ন ফোরামের চেয়ারম্যান জননেতা আলহাজ্ব আরিফুর রহমান চৌধুরী মানিক। তিনি জানান, ৪দিনের বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে ক্ষয়ক্ষতি নিরুপন করে এবং দ্রুত সময়ে বেড়িবাধ মেরামত করে সর্বস্তরের চকরিয়াবাসীকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে হবে। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় আসার আগেই যেন তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসা হয়। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন এবং মহান আল্লাহর কাছে সকলের জন্য হেদায়ত কামনা করেন।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে পৌরএলাকার কোচপাড়ায় পাউবোর ১নং গাইড বাধ পরিদর্শন করেন কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আজিজ মোহাম্মদ চৌধুরী, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোজাফ্ফল হোসেন। ওইসময় তারা বলেন, বর্তমানে মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার পাঁচ ফুট উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাঘগুজারা ও পালাকাটা রাবার ড্যাম এলাকায় বেড়িবাধ ভেঙ্গে গিয়ে নদীর পানি প্রবেশ করেছে লোকালয়ে। ওই এলাকার লোকজনকে সরিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।