ঠিক এই মুহূর্তে যে শিশুটির জন্ম হলো, তারও মাথাপিছু ঋণ প্রায় ৪০ হাজার টাকা। আর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নতুন যে বাজেট দিলেন, তাতে মাথাপিছু ঋণ বেড়ে হবে ৪৬ হাজার ১৭৭ টাকা।
অর্থমন্ত্রী বড় বাজেট দিলেও বেশি আয় করতে পারছেন না। এতে বাড়ছে বাজেট ঘাটতি। আর তা মেটাতে তাঁর ভরসা এখন ঋণ। এই ঋণ প্রতিবছরই বাড়ছে। আবার সহজ শর্তের বৈদেশিক ঋণপ্রাপ্তিও কমে গেছে। ফলে অর্থমন্ত্রী বেশি নিচ্ছেন ব্যয়বহুল অভ্যন্তরীণ ঋণ। এতে বাজেট শৃঙ্খলাও নষ্ট হচ্ছে।
কেননা, এ কারণে বিশাল টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে সুদ পরিশোধে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শুধু সুদ পরিশোধে যত টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তা দিয়ে পদ্মা সেতুর মতো একটি সেতু নির্মাণ করার পরও আরও টাকা বেঁচে যাবে। আর সুদ পরিশোধে আর এত বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখতে না হলে সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেশি রাখতে পারত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ ঋণ অনেক ব্যয়বহুল। সেই ঋণের একটা মোটা অংশ যদি হয় সঞ্চয়পত্র, তাহলে তা আরও ব্যয়বহুল। সরকার ব্যয়বহুল ঋণ বেশি নিচ্ছে, এর অর্থই হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার খাতগুলোয় সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ রাখতে পারছে না।’
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে পুরো দেশের মানুষের ওপর ৬ লাখ ৫৯ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। আগামী অর্থবছরে নতুন করে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি ঋণ নেবে সরকার, যার দুই-তৃতীয়াংশই আসবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। সুদসহ আগের বছরগুলোর মূল টাকাও সরকার প্রতিবছর পরিশোধ করে আসছে। পরিশোধ না হওয়া টাকা জমতে জমতেই ঋণের বোঝা এত বড় হয়েছে।
অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান এ বিষয়ে বলেন, অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ বেশি টাকা রাখা হচ্ছে ঠিক আছে, এই টাকা কিন্তু দেশেই থাকছে। বৈদেশিক ঋণ বেশি নিলে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ পরিশোধ করতে হতো। তার চেয়ে এটাই ভালো। তা ছাড়া আপাতদৃষ্টে বৈদেশিক ঋণের সুদের হার কম মনে হলেও আসলে কম না। তাদের অনেক শর্ত থাকে এবং পরামর্শক ফি বাবদ অনেক টাকা খরচ করতে হয়।
আগামী অর্থবছর শেষে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে রাষ্ট্রের মোট ঋণ দাঁড়াবে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে দেশের ভেতর থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ ২ লাখ ৯০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, সরকার ঠিকমতো ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না বলেই এর দায় নিতে হচ্ছে জনগণকে। তিনি বলেন, একসময় দেশি-বিদেশি ঋণের হার ছিল অর্ধেক অর্ধেক। বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে যেহেতু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রশ্নটি থাকে, সরকার তাই সে পথে যায় না। সরকার সহজ পথ হিসেবে বেছে নেয় বেশি সুদের অভ্যন্তরীণ উৎসকে। সুষ্ঠু ঋণ ব্যবস্থাপনার জন্য আহসান এইচ মনসুর আলাদা একটি বিভাগ গঠনের পরামর্শ দেন।
বাজেট পেশের দুই দিন আগে গত ৩০ মে দেশের জনসংখ্যার একটি হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বিবিএস আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, গত ১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার। সে হিসাবে আগামী অর্থবছর শেষে দেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৬ কোটি ৫০ লাখ এবং মাথাপিছু ঋণ দাঁড়াবে ৪৬ হাজার ১৭৭ টাকা। বর্তমানে মাথাপিছু ঋণ ৩৯ হাজার ৯৬৩ টাকা।
১ জুন বাজেট পেশের দিন প্রকাশিত মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বাজেটের আকার বাড়ছে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ছে না। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে চলেছে এবং সরকার বাধ্য হয়ে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে।
সুদ পরিশোধে এত টাকা!
আগামী অর্থবছরের জন্য দেওয়া ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে অনুন্নয়ন বাজেট ২ লাখ ৪৫ হাজার ১৪ কোটি টাকার। এর মধ্যে সুদ পরিশোধে রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদই ৩৯ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। মোট বাজেটের প্রায় ১৭ শতাংশ অর্থই ব্যয় হচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধে। সুদ পরিশোধের পুরো বরাদ্দ কোন কোন খাতে ব্যয় করা হবে, বাজেটে তার চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা ব্যয় হবে সঞ্চয়পত্রের সুদে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় হবে মেয়াদি ঋণের সুদে।
আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দের অঙ্কটির দিকে তাকালেই বোঝা যায় অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর সরকারের নির্ভরতা কত বেশি। দুঃখজনক যে সস্তা সুদের বৈদেশিক ঋণ নিতে পারছি না একশ্রেণির সরকারি কর্মচারীর অযোগ্যতার কারণে।’
সঞ্চয়পত্রেই সুদের অর্ধেক
বাজেট সংক্ষিপ্তসারের অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয়ের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদ দিতে বরাদ্দ রাখা আছে ১৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ১৬ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা রাখা হলেও সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে করা হয় ১৫ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরে ১৪ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা আছে মেয়াদি ঋণের সুদ বাবদ।
যদিও ১০ মাসেই (জুলাই-এপ্রিল) ৪৩ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। সংশোধিত বাজেটে বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়। অথচ চলতি অর্থবছরে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। আগামী অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী ব্যাংকের সুদের নিম্নহার নিয়ে কথা বললেও সঞ্চয়পত্র নিয়ে কিছু বলেননি। তবে বাজেট পেশের আগে-পরে এবং সর্বশেষ গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সঞ্চয়পত্রের এত সুদ (গড়ে ১১ শতাংশ) তিনি রাখবেন না, ব্যাংকের সুদের (৭ শতাংশ) চেয়ে ২ শতাংশ বাড়িয়ে নতুন হার করবেন।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থমন্ত্রী সঞ্চয়পত্রের সুদের হারটি কমাতে পারবেন বলে মনে হয় না। কারণ, সরকারি বড় পদের কর্মচারী, রাজনীতিবিদ ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এর সুবিধাভোগী।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।