২৪ নভেম্বর, ২০২৪ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২১ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬


শিরোনাম
  ●  ব্যাটারী চালিত ই-বাইক মালিক সমিতি মরিচ্যা ও মৌলভী পাড়া কমিটি অনুমোদন   ●  টেকনাফ সমুদ্রে গোসলে নেমে মাদ্রাসার এক ছাত্রের মৃত্যু দুই ছাত্র নিখোঁজ।   ●  মাকে হত্যার পর থানায় ছেলের আত্মসমর্পণ।   ●  মারমেইড বীচ রিসোর্টে বালিয়াড়ি দখল করে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান   ●  যারা খেলাধূলা করছে, তারা বিএনপির শক্তিকে অনুধাবন করতে পারছে না   ●  উখিয়ার নতুন ইউএনও কামরুল হাসান চৌধুরী   ●  উখিয়ায় যৌথবাহিনীর অভিযানে শক্তিশালী গ্রেনেড উদ্ধার   ●  ছয় কোটি তরুণের দেয়াল লিখন বাংলাদেশের নতুন সংবিধান   ●  চকরিয়ায় ২টি ডাম্পার ট্রাক ও এক্সকেভেটর জব্দ   ●  ধরে নিয়ে যাওয়া ২০ বাংলাদেশী  জেলেকে ফেরত দিল আরাকান আর্মি

মানবিক আশ্রয় ও চিকিৎসা সেবায় সন্তুষ্ট ছেনুয়ারা ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন

এ এইচ সেলিম উল্লাহঃ ‘পূর্ব পুরুষের আবাসস্থলে ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার হয়েছি। চারিধিকে নির্বিচারে হত্যার মিছিল দেখে শিশুসন্তানসহ পালাচ্ছিলাম। কিন্তু সেখানেও রক্ষা হয়নি। দু’পায়ে ৪টি গুলির দানার আঘাত নিয়ে প্রাণ রক্ষায় এসেছি প্রতিবেশী বাংলাদেশ। এখানে মানবিক আশ্রয়ের পাশাপাশি সূস্থতার যে চিকিৎসা সেবাও পাচ্ছি তা ভূলার নয়। এখানকার  (বাংলাদেশের) সরকার প্রধান মানবতার খাতিরে খাবারসহ সব ধরণের সুবিধা দিচ্ছেন। এরপরও তিনটি শিশুসন্তান ও নিজের ভবিষ্যত নিয়ে চরম উদ্বিগ্নতায় সময় পার করছি।’
মঙ্গলবার বিকেলে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে রোহিঙ্গা সার্জারী ইউনিটের বেডে শুয়ে নিজের উপর ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া সহায়তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মিয়ানমারের বুচিদং আমতলার ছেনুয়ারা বেগম (২৫) এসব অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন।
শুধু তিনি নন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আহত হয়ে একই স্থানে চিকিৎসা নিচ্ছেন মংডুর ধলু হোসেন (৫৫) ও ভাঙ্গা ডান হাতের চিকিৎসা করাচ্ছেন মংডু গুলজারপাড়ার ফাতেমা বেগম (৬০)সহ অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা।
চিকিৎসাসেবা নেয়া রোহিঙ্গা নারী মরিয়ম, শাহেনা আক্তার, ফরিদা বেগম, আব্দুল জব্বারসহ অনেকে জানিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের পর আহতবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। আহত রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প এলাকার এনজিও হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেয়ে পাঠানো হচ্ছে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে। এভাবেই তারা এখানে এসেছে সেবা পাচ্ছেন।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. পুঁ চ নু জানান, মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতার শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে খোলা হয়েছে অস্থায়ী রোহিঙ্গা সার্জারী ইউনিট। গত ২৫ আগস্ট থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এখানে ১৭৭ জন রোহিঙ্গা রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়েছে। এদের মাঝে পুরুষ ছিল ৮১ জন, নারী ৫৩ এবং ৪৩ জন শিশু। সাধারণ রোগীদের পাশাপাশি অগ্নিদগ্ধ রোগীর সেবাও দেয়া হচ্ছে অস্থায়ী রোহিঙ্গা সার্জারী ইউনিটে।

জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মো. শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী জানান, প্রথমদিকে সাধারণ ওয়ার্ডে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা দেয়া হয়। পরবর্তীতে রোগীর পরিমাণ বাড়তে থাকায় কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় তাদের জন্য আলাদা ইউনিট খোলে। এখানে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে দুই ব্লকে ৫টি কক্ষ। সেখানে ৩ শিফটে নিয়োজিত চিকিৎসকরা ২৪ ঘন্টা সেবা দিচ্ছেন। ২৬ সে্েপ্টম্বর রোহিঙ্গা ইউনিটে ৫৩ রোগী ভর্তি আছে। এ ইউনিটে অস্ত্রোপচারে ৪ এবং নরমাল ডেলিবারি হয়েছে আরো ৬ শিশুর। এখানে চিকিৎসা নিতে আসাদের মাঝে একজন সে দেশে সহিংসতায় আহত এবং অন্যজন এখানে হাতির আক্রমনে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন মারা গেছেন।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স উম্মে সালমা বলেন, প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এরমধ্যে গুলিবিদ্ধ ও ডায়রিয়া রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা বেশি। এসব রোহিঙ্গা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। হাসপাতালের নানা ব্যস্ততার মাঝেও স্থানীয় রোগীদের মতো রোহিঙ্গাদেরও নানা সুযোগ সুবিধার কমতি রাখা হচ্ছে না।
চলমান রোহিঙ্গা সার্জারি ইউনিটের ইনচার্জ শামসুন্নাহার বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য খোলা সার্জারি ইউনিটে সার্জারি, গুলিবিদ্ধ ও পোড়া রোগী সেবা নিচ্ছে। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত এখানে ভর্তি রয়েছে ৫৩ রোগী। এখানে ভর্তি হওয়া ১৭৭ জনের মাঝে অবস্থা বেগতিক হওয়ায় ৫৫ জনকে চমেক হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। ২১ গর্ভবতী নারী চিকিৎসার জন্য আসে আর এদের মাঝে ১২ জন সেবায় সূস্থতা নিয়ে ক্যাম্পে ফিরেছে। একজন গর্ভবতীকে জরায়ু সমস্যার কারণে রেফার করা হয়। মঙ্গলবার ভর্তি রয়েছে ৭ জন।

এদিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ছাড়াও কুতুপালং কমিউনিটি ক্লিনিক, এমএসএফ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালেও রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট। কুতুপালং এলাকায় তারা আলাদা ক্যাম্প বসিয়ে ফ্রি-চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

জাতিসংঘ এবং ‘আইওএম’ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারে সহিংসতার পর থেকে এ পর্যন্ত চার লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধদের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে আসা অনেক রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ, জখমসহ নানাবিদ রোগে আক্রান্ত। যারা গুরুতর আহত তারা এখন ভিড় করছে জেলা সদর হাসপাতালে। তাদের জন্যই খোলা হয়েছে আলাদা রোহিঙ্গা সার্জারি ইউনিট।

প্রসঙ্গত, গত ২৪ আগষ্ট রাতে মিয়ানমারের কয়েকটি সেনা ও পুলিশের চৌকিতে রোহিঙ্গা জঙ্গি হামলার অভিযোগে আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন শুরু করে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। হত্যা, ধর্ষণের পাশাপাশি গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে চার লাখের বেশী রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট।


৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরৃ করে সেদেশের সরকার।
সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত ৪শ’র বেশি মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। নৌপথে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতেও বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
এই শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার আহ্বান জানানো হলেও মিয়ানমার তাতে সাড়া দেয়নি। রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতেও তারা রাজি নয়।
রোহিঙ্গাদের এই স্রোত ঠেকাতে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মতো কোনো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে একাধিক নিরাপদ এলাকা (সেইফ জোন) গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ। এছাড়া সীমান্তে যৌথ টহলেরও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। কিন্তু কোনো প্রস্তাবেই মিয়ানমারের আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকান্ড শুরু করে।

এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।