মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে (রিভিউ) জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের দায়ের করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ গতকাল এ রায় দেয়। সকাল ৯টা ৫ মিনিটের দিকে প্রধান বিচারপতি রিভিউ আবেদন ডিসমিসড-এর ঘোষণা দেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা ছিলেন- বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
এ রায় ঘোষণার পর দিনভর আলোচনা চলে কখন কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। বিকাল থেকে রাতেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আভাস মেলে। কারাকর্তৃপক্ষ যখন কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের তার সঙ্গে দেখা করতে বলে তখন বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যরা কামারুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেন। তবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশের কপি না পৌঁছায় গতরাতে রায় কার্যকর সম্ভব হয়নি। আদেশের কপি পাওয়ার পর যেকোন সময় কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার সৈয়দ আমিনুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের জানান, আদেশ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এসে পৌঁছায়নি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী রাত ৮টার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, আমি এখন পর্যন্ত আদালতের রায়ের কপি পাইনি। রায়ের কপি না পেয়ে রায় সংক্রান্ত কোন কার্যক্রম করা যাবে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আইনজীবীদের সঙ্গে তার (কামারুজ্জামান) দেখা করার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরিবারের সদস্যরা রায়ের পর দেখা করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। সেজন্য তারা দেখা করেছেন।’ তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী যে সুবিধা দেয়ার কথা তাই তাকে (কামারুজ্জামান) দেয়া হচ্ছে। বিধি-বিধান মেনেই আমরা আমাদের কাজ করছি।’
রায়ের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, যত দ্রুত সম্ভব কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হবে। তিনি বলেন, কাদের মোল্লার মামলায় আপিল বিভাগ পরিষ্কার বলে দিয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ক্ষেত্রে জেল কোড প্রযোজ্য হবে না। তাই প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার যে সময়ের কথা জেল কোডে বলা হয়েছে তাও প্রযোজ্য হবে না। এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের বিষয়টি এখন পুরোপুরি সরকারের হাতে। এক্ষেত্রে কারাবিধি কার্যকর হবে না। অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবী শিশির মনির জানান, প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না সে ব্যাপারে কামারুজ্জামানই সিদ্ধান্ত নিবেন। আইনজীবীরা এ নিয়ে আলোচনার জন্য কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও তাদের সে অনুমতি দেয়া হয়নি। এদিকে, রায় ঘোষণার পর আজ মঙ্গল ও আগামীকাল বুধবার সারা দেশে হরতাল ডেকেছে জামায়াত। দলটির ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ এক বিবৃতিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। রিভিউ খারিজের খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছে জামায়াত-শিবির। নোয়াখালীতে পুলিশের গুলিতে এক শিবিরকর্মী নিহত হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জে একটি যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
আমরা বিচলিত নই: কামারুজ্জামানের ছেলে
গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে কামারুজ্জামানের স্ত্রী নুরুন্নাহার, মেয়ে আছিয়া নূর, দুই ছেলে হাসান ইকবাল ইয়ামি ও হাসান ইমাম ওয়াফি, ভাগ্নি রুকসানা জেরিনসহ ১২ জন কারাফটকের সামনে যান। সন্ধ্যায় ৬টা ৪৫ মিনিটে একজন বাদে বাকিরা কারাগারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। এক ঘণ্টা পর রাত পৌনে ৮টায় তারা কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। এসময় কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইকবাল ইয়ামি বলেন, ‘যে রায় সরকার দিয়েছে তা ঐতিহাসিকভাবে ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। তার (কামারুজ্জামান) ওপর জুলুম করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে এই রায়ে যারা জড়িত, আল্লাহ তাদের বিচার করবেন।’ কারাগার থেকে বেরোনোর সময় কামারুজ্জামানের মেয়ে আছিয়া নূর সবার উদ্দেশ্যে ‘ভি’ চিহ্ন দেখান। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাসান ইকবাল বলেন, ‘এ ঘটনায় আমরা বিচলিত নই। হাসিমুখে আমরা তাকে বিদায় জানাতে এসেছি এবং হাসিমুখে চলে যাচ্ছি।’ হাসান জানান, ফ্যামিলির উদ্দেশ্যে তার বাবা বলেছেন, ‘সৎ পথে থেকো, সৎ উপার্জন করো।’ তিনি বলেন, ‘আব্বা কোন অপরাধ করেননি। সোহাগপুরের যে ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন।’ হাসান বলেন, ‘আব্বা সুস্থ ও মানসিকভাবে শক্ত রয়েছেন।’ এটা শেষ দেখা কিনা সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন করলে হাসান ইকবাল বলেন, ‘এটা শেষ দেখা না। শেষ দেখা হলে একান্তভাবে কথা বলার সুযোগ দেয়া হতো। তা দেয়া হয়নি। এটা শেষ দেখা না বলেই আমরা মনে করি।’ ক্ষমাপ্রার্থনা প্রসঙ্গে হাসান ইকবাল বলেন, ‘এ ব্যাপারে আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন।’ পরমুহূর্তেই তিনি আবার বলেন, ‘কেন ক্ষমা চাইবেন? তিনি কি অপরাধ করেছেন?’ হাসান বলেন, তরুণ প্রজন্ম প্রহসনের এই রায়ের সমুচিত জবাব দেবে।
রিভিউ খারিজ
রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের দায়ের করা আবেদনের ওপর আপিল বিভাগে শুনানি হয় রোববার। কামারুজ্জামানের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি প্রধানত চারটি পয়েন্টে তার বক্তব্য উপস্থাপন করে আপিল বিভাগের কাছে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জানান। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, কামারুজ্জামান আলবদর কমান্ডার ছিলেন। আলবদর বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের চেয়েও জঘন্য অপরাধে জড়িত ছিল। কামারুজ্জামান কোন ধরনের অনুকম্পা পেতে পারেন না। ওইদিন শুনানি শেষে আদালত সোমবার রায়ের দিন ধার্য করেন। ২০১৩ সালের ৯ই মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল দায়ের করেন। গত বছরের ৩রা নভেম্বর আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি এ মামলায় আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পরদিন তার বিরুদ্ধে মৃত্যুপরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। গত ৫ই মার্চ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে রিভিউ আবেদন দায়ের করেন কামারুজ্জামান।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।