কর্মস্থল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের পথে, বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে, এমনকি ঘরের মধ্যেও ধর্ষণসহ পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারী। বাদ যাচ্ছে না শিশুরাও। নারী সংগঠন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দেওয়া তথ্য মতে, গত ৬ মাসে ১ হাজার ৫৭৬ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যাদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৫১৪ জন।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত ৩ টি কারণে দিন দিন ধর্ষণের মাত্রা বাড়ছে। বিশ্বায়নের ফলে আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবে সমাজে নৈতিক অবক্ষয় বাড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার সাধারণ জনগোষ্ঠীকে ব্যভিচার, অনৈতিক সম্পর্ক, `হিরোইজম’ বা দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করছে। এতে নিম্ন শ্রেণির জনগোষ্ঠী বেশি প্রভাবিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বা উগ্রভাব বাড়ছে। এই নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটছে বলে মনে করছেন তাঁরা। এ ছাড়া অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকায় অপরাধীরা উৎসাহ পাচ্ছে। অপরাধীদের কঠোর সাজা হলে এ ধরনের অপরাধ কমবে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কিছুদিন ধরে একের পর এক ধর্ষণ ও নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। বর্তমানে দেশের সবচে আলোচিত ঘটনার মধ্যে রয়েছে বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ। এ ঘটনায় সমাজের উচ্চবিত্তরা জড়িত। অনেক জল ঘোলার পর পুলিশ দুই ধর্ষককে গ্রেফতার করেছে। এছাড়া সিলেটের জৈন্তাপুরে গত ৬ মাস ধরে মা, মেয়ে ও খালাকে ধর্ষণ করে তা ভিডিও প্রকাশ করার দায়েও একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খোদ রাজধানীতে সৎ বাবার হাতে ধর্ষিত হতে হয়েছে ১৩ বছরের মেয়েকে। এমনকি ধর্ষণের বিচার না পেয়ে গাজীপুরে বাবা ও মেয়ের আত্নহত্যার সাম্প্রতিক ঘটনা সারাদেশকে নাড়া দিয়েছে।
মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক মাহতাব খানম বলেন, এখনো ধর্ষণের ঘটনায় সমঝোতা হচ্ছে গ্রাম্য সালিসে। ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ করতে কমপক্ষে দুজন সাক্ষী লাগে। এছাড়া আদালতে গিয়ে নতুন করে ধর্ষণের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার ভয়ে অনেকেই আসামিপক্ষের সঙ্গে আপস করে। ‘সামাজিক সম্মানের’ ভয়েও অনেকে আদালত পর্যন্ত না গিয়ে পিছু হটে। এতেও ধর্ষকরা শাস্তি থেকে রেহাই পায়। ধর্ষণ প্রতিরোধে অভিভাবকসহ নারীদেরও সচেতন হওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।
এদিকে, সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে যেখানে বন্ধু বা সহকর্মীর সঙ্গে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে নারী। তাঁদের মতে, নারী ও শিশু ধর্ষণের ভয়াবহতা কমানোর জন্য সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, ‘বিশ্বায়নের প্রভাবে ভোগবাদী সংস্কৃতির বিস্তার ঘটছে, যার সঙ্গে আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সমন্বয় হচ্ছে না। হিন্দি সিনেমা ও সিরিয়ালে নতুন ধরনের নৃশংসতাকে দেখানো হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে পরকীয়া, ধর্ষণ। নারীদের ভোগ ও বিলাসের মাধ্যম হিসেবেও উপস্থাপন করা হচ্ছে। শিক্ষিত সমাজ এটি এড়িয়ে চললেও এতে প্রভাবিত হচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে ধর্ষণ বাড়ছে।’
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ নৈতিক অবক্ষয়। শাস্তি ও সচেতনতাই পারে এ ধরনের অপরাধ কমাতে। ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোতে দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত। একটি অপরাধ দেখেই অন্যদের সুপ্ত ‘অপরাধ মন’ জাগ্রত হয়। অপরাধের শাস্তির বিষয়টি সামনে এলে সে অপরাধ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবে।
মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, ‘ধর্ষণ, অপহরণের পর হত্যা এবং ধর্ষণের পর হত্যা তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরো তৎপর হওয়া এবং সাক্ষীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা দরকার। মামলা অনেক ঝুলে আছে। ডিএনএ পরীক্ষা নিশ্চিত করা এবং অপরাধ প্রমাণের বোঝা এখনো নারীর ওপর। সেটাও পরিবর্তন করা দরকার।’
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।