আবদুল আজিজ,(বাংলাট্রিবিউন): সে দিল সকালটাও যেন ভাল লাগছিলা আনাছ মিয়ার। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যখন সূর্য্য উকি দিচ্ছিল তখনই কেমন যেন মনে হলো তার। বাবা নমিউদ্দিনকে বলছিলো আজ মিলিটারী আসতে পারে গ্রামে। মা মোবারেকাও তাই বলছিল। তাই মা এবং ভাই বোনদের নিরপাদে সরিয়ে রাখায় পরামর্শও দিয়েছিল সে। কিন্তু, বাবা নমি উদ্দিন তার কথার কোন কর্নপাত করেননি। সকালে মায়ের রান্না করা গরম ভাত খেয়েই বাবার সাথে মাঠে কাজ করতে চলে যায় এই ছোট ছেলেটি। মায়ের সেই হাতের রান্না করা খাবার যে শেষ খাবার হবে কে জানতো? প্রশ্ন আনাছ মিয়ার…।
আনাছ মিয়া বলেন, মাঠে কাজ করতে গিয়ে সকাল পেরিয়ে দুপুরের যখন সুর্য্য পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করলো, তখন পেটের ক্ষুধায় জানান দিলো এখনো বুঝি বাড়ি ফিরতে হবে তাদের। বাবার সাথে বাড়ি ফিরার প্রস্তুতি নেয় আনাছ মিয়া। বাবা নমি উদ্দিনের পেছনে পেছনে যখন বাড়ির আঙ্গিনার কাছাকাছি পৌছলো তখনই গ্রামের দৌড়াদোড়ি, মানুষের আত্মচিৎকার শুরু হয়। কিছু বুঝে উঠার আগেই গ্রামে ডুকে পড়ে মিলিটারি (সেনাবাহিনী) ও সে দেশের উগ্র-মগরা। গ্রামে ঢোকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ ও বাড়িঘরে আগুন দেয়া শুরু করে। বাড়ির মুল্যবান আববাসপত্র গুছিয়ে নেয়ার আগেই তার বাড়িতে পৌছে যায় সেনা বাহিনীর একটিদল। এসময় পালিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা সবার। এতে একের পর এক গুলিবর্ষণ করে সেনাবাহিনী ও মগরা। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর গুলিতে লুঠিয়ে পড়ে বাবা মা দুইজনই। একইভাবে তার শরীরেরও গুলি লাগে নাকে, হাত ও পায়ে। কিছুক্ষণ অজ্ঞান থাকার পর পুনরায় জ্ঞান ফিরে পেলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় আনাছ মিয়া। সঙ্গে সাথে থাকা তিন ভাই-বোনরা কোথায় গেছে আর খেয়াল করতে পারেনি। পরে শুনেছে তারাও সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে। পালিয়ে এসে দূর থেকে পিতা-মাতার হত্যাকান্ড, বাড়িঘর জালিয়ে দেয়ার দৃশ্য এবং গ্রামের দিনভর সেনাবাহিনী ও মগদের তান্ডব, বর্বরতা নিজ চোখে দেখেছে দশ বছরের রোহিঙ্গা শিশু আনাছ মিয়া। এসময় বানের স্রোতের মতো এলাকার প্রতিবেশী বাংলাদেশের দিকে রওয়ানা হয়। কিন্তু, বাবা-মা ও ভাই বোনদের লাশ ফেলে বাংলাদেশে আসতে মন চায়নি তার। গুলিতে বাবা-মা মাটিতে লুঠিয়ে পড়ার দু:সহ স্মৃতি বার বার তাকে নাড়া দেয়। পরে স্থানীয় প্রতিবেশীরা জোর করেই নিয়ে আসে বাংলাদেশে। সীমান্ত পেরিয়ে এসে তার ঠাঁই হয়েছে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।
এখন সে উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-ব্লকে বাসিন্দা। এই ক্যাম্পেই আনাছ মিয়া তার দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেয়। রাখাইন রাজ্যের মংডুর রায়বইল্যা গ্রামের এই আনাছ মিয়া ক্যাম্পে এসে খুঁজে পায় তার দাদা-দাদিকে। তারা আগেই পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। এখন তাদের সঙ্গে ওই ক্যাম্পের ডি-ব্লকে থাকছে আনাছ। ক্যাম্পের এমএসএফ হাসাপাতালে চিকিৎসা নিয়ে তার অবস্থারও উন্নতি হলেও এখনো নাকের ক্ষতটি এখনো শুকায়নি।
এদিকে গত ১২ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গাদের অবস্থা পরিদর্শনে কুতুপালং যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয় আনাছের। এসময় প্রধানমন্ত্রী তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দেন। এসময় প্রধানমন্ত্রীর দেখা পেয়ে আবেগ আপ্লুত হয় সব হারানো শিশুটি। প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন সেটি ভাগ্যের ব্যাপার বলে জানান আনাছ মিয়া। আনাছ মিয়া বলেন, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী যখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল তখন বার বার মায়ের কথায় মনে পড়ছিলো। এই কথা বলেই মায়ের শোকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আনাছ মিয়া। কথা বলতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে সে।
শুধু আনাছ মিয়া নয়, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে আনাছ মিয়ার মতো প্রায় দেড় লাখ শিশু। তাদের মাথার উপরে নীল আকাশ, নিচে বিস্তৃর জমিন, তাতেই বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি। ক্যাম্পের পথে পথে মানুষের সারি, তাবুতে তাবুতে শিশুর কান্নার রোল। আর পেছনে পড়ে আছে স্বজন হারানোর দুঃসহ বেদনার্ত জীবনের গল্প। গুলির মুখে এসব মানুষ হারিয়েছে প্রিয় স্বামী, সন্তান আর পিতামাতা ও স্বজনকে। এসব নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের একটাই প্রশ্ন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে তারা কি স্বদেশে ফিরে যেতে পারবে?
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।