রফিকুল ইসলাম: মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইন উগ্রপন্থিদের চরম নির্যাতনের মুখে রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা। এখনো বিচ্ছন্ন ভাবে ত্রান ও নিশ্চিত নিরাপদ থাকা খাওয়ার টানে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যহত রয়েছে। অন্যদিকে উম্মুক্ত সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দালালের হাত ধরে প্রতি নিয়ত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে যাতায়াতের খবর পাওয়া গেছে। এসব যাতায়াতকারীদের কিছু কিছু সেখানে থেকে গেলেও কারও কারও নিখোঁজের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে রাতের অন্ধকারে গোপনে রাখাইনে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা সহায় সম্পদ ও গরু ছাগল লুটপাট করে নিয়ে আসছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জাহাঙ্গীর আলম (২২), মোঃ আয়ুব (২০) সহ ৫ রোহিঙ্গা যুবক গত বুধবার সীমান্তের আমতলী গর্জন বনিয়া পাহাড়ী এলাকা দিয়ে উত্তার রাখাইনে যায়। রাখাইনের ফকিরা বাজার থানার রেইক্কা পাড়ায় তাদের ফেলে আসা ঘরবাড়ি, সহায় সম্পদ দেখতে যায় বলে খবর পাওয়া গেছে। উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া অস্থায়ী শিবির আগষ্টের শেষের দিকে ফকিরা বাজারের রেইক্কা পাড়া, বদলা পাড়া থেকে পালিয়ে এসে এসব রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেয়। মংডুর মৌলভী জায়গা নামক বালুখালী গ্রামের ছৈয়দুর বসরের দুই ছেলে তমিজ উদ্দিন (৪০) ও তাজউদ্দিন (৩৮), টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্ত দিয়ে ১৩/১৫ দিন পূর্বে স্বপরিবারে রাখাইন চলে যায়।
সম্প্রতি তারা রাখাইন থেকে অন্যান্য রোহিঙ্গাদের সাথে পালিয়ে এসে উখিয়ার বালুখালী ঢালা অস্থায়ী শিবির আশ্রয় নেয়। টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ে রয়েছে তাদের ভাড়া বাসা। কুতুপালংও রয়েছে নিজেদের নামে আবাসন। তারা রাখাইনে বর্ডার গার্ড পুলিশ বা বিজিপির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার করে থাকে বলে অপরাপর রোহিঙ্গাদের অভিযোগ। এদের সাথে রাখাইনের একই গ্রামের জাফর আলমের চার পুত্র খাইরুল্লাহ, আব্দুল আজিজ ভুলু, আবুল ওসমান কালু ও মুফিজ উদ্দিন স্বপরিবারে গোপনে মিয়ানমারে চলে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তারাও উখিয়ার বালুখালী ঢালায় অস্থায়ী আশ্রয় শিবির থেকে গোপনে পালিয়ে গিয়ে কয়েকদিন রাখাইনে অবস্থান করার পর আবারও উক্ত অস্থায়ী আশ্রয় শিবির ফিরে এসেছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পার্শ্ববর্তী রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন। এসব রোহিঙ্গাদের মতে কিছু কিছু রোহিঙ্গা মিয়ানমারের বিজিপির সাথে সম্পর্ক রেখে ইয়াবা পাচার করে থাকে।
এখানে তারা পালিয়ে আসলেও রাখাইনে ঘরবাড়ি, সহায় সম্পদ ও অবৈধ ব্যবসা পুনঃ চালু করার জন্য মিয়ানমার যাতায়াত করছে। রাখাইনের বলি বাজার এলাকার লিয়াকত আলীর ছেলে কোরবান আলী, মাষ্টার আব্দুর রজ্জাক ও মমতাজ মিয়া স্বপরিবারে গোপনে গত সপ্তাহে পালিয়ে গেছে। এরা উখিয়ার পালংখালী শফিউল্লাহ কাটা অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। গত সপ্তাহে উখিয়ার পালংখালী তাজনিমার খোলা অস্থায়ী আশ্রয় শিবির থেকে গোপনে পশ্চিম রাখাইনের কুমির খালী গ্রামের আরশাদ আলীর চার ছেলে গুরা মিয়ার আট জনের পরিবার, উলা মিয়ার পরিবারের আট জন, লালু মিয়ার পরিবারের সাত জন ও নবি হোছনের নয় জন গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেছে বলে জানা গেছে। এধরনের বিভিন্ন আশ্রয় শিবির থেকে কিছু কিছু রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্ন ভাবে সে দেশের বিজিপির সাথে গোপন সম্পর্ক গড়ে তুলে পালিয়ে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
এসব রোহিঙ্গারা দেশে চলে গেলেও তাদের পরিবারের দু’য়েক জন সদস্য উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয় শিবির থেকে গিয়ে তাদের নামে প্রাপ্ত ত্রান সামগ্রী উত্তোলন করে তা বেচা বিক্রি করছে নিয়মিত। রোহিঙ্গাদের সূত্র জানিয়েছে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের প্রায় সকলেই বাংলাদেশে চলমান রোহিঙ্গা নিবন্ধন কার্যক্রমে আংশ নিয়ে ইতিমধ্যে পরিচয় পত্রও নিয়েছে। আবার রাখাইনে ফিরে গিয়ে গোপনে সে দেশের সেনাবাহিনী ও বিজিপির সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে এনভিসি কার্ডও নিচ্ছে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, বেশ কয়েক বছর ধরে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী হিসেবে এনভিসি কার্ড দেওয়ার তোড়জোড় চালালেও রোহিঙ্গারা এসব এনভিসি নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। এর পরও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে বিদেশী সংস্থা ও গণমাধ্যম গুলোকে অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছে বলে রোহিঙ্গাদের অভিযোগ।
অন্যদিকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের একটি অংশ রাতের অন্ধকারে রাখাইনে গোপনে প্রবেশ করে সেখানে বিজিপির সহায়তায় লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের রেখে আসা ঘরবাড়ি, সহায় সম্পদ, গবাদি পশু ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে বিক্রি করে দিচ্ছে বলে জানান রোহিঙ্গারা। এধরনের চুরি করে রাখাইনে যাওয়াদের সাথে বিজিপির সম্পর্ক নেই তাদের ফেলে গুলি করে মারছে। এধরনের বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা যুবক নিখোঁজ রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির সেক্রেটারী মোঃ নুর ও বালুখালী রোহিঙ্গা শিবির কমিটির সভাপতি লালু মাঝি জানান লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা কে কোন দিকে কিভাবে কোথায় যাচ্ছে বা থাকছে তা হিসেবে রাখা কঠিন। তবে কিছু কিছু রোহিঙ্গা গোপনে মিয়ানমার চলে যাচ্ছে বলে তারাও জানতে পেরেছে বলে জানান। কক্সবাজার-৩৪ বিজিবির মেজর মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি অবগত নন। তবে সেখানে রোহিঙ্গাদের সহায় সম্পদ বা ইয়াবা পাচারে অনেক আগে থেকে কিছু রোহিঙ্গাদের সে দেশের সেনাবাহিনী ও বিজিপির সাথে সম্পর্ক থাকতে পারে বলে তিনি জানান।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।