নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনসহ চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে রাষ্ট্রপতিই এখন শেষ ভরসার জায়গা বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজনরা।
তারা বলছেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এমন নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী ইসি গঠনের পথ সুগম করতে একমাত্র রাষ্ট্রপতিই পারেন কার্যকর উদ্যোগ নিতে। শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার আস্থাহীনতা কাটিয়ে দেশের স্বার্থে এবং গণতন্ত্র রক্ষায় রাষ্ট্রপতি হতে পারেন শেষ অভিভাবক।
তিনিই পারেন বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট সংলাপের দ্বার উন্মোচন করতে। আর দেশের ১৬ কোটি মানুষের এমন প্রত্যাশা পূরণ হলে ইতিহাসের বিশেষ জায়গায় তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তারা মনে করেন, রাষ্ট্রপতির এমন উদ্যোগ নেয়ার পথ সুগম করে দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তারা তা মেনে নেবেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও বলেছেন, তারা রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না।
বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুতে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ বের করার দাবি জানিয়েছেন। তাই এরকম একটি প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতির এ সংলাপ আয়োজন সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আওয়ামী লীগ সরকার মনোনীত হলেও তিনি এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। সেক্ষেত্রে দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে তিনি শক্তিশালী স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনসহ প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিদ্যমান দূরত্ব ঘোচাতে মহতী উদ্যোগ নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেন।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন রাষ্ট্রপতির সংলাপের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘দেশের আশা-আকাক্সক্ষার শেষ কেন্দ্রস্থল হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি আমাদের প্রধান অভিভাবক।
তিনি চাইলে অনেক সমস্যারই সমাধান সম্ভব। আমি আশা করি, বর্তমান রাষ্ট্রপতি আমাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলমান সংকট সমাধানে একটি সম্মানজনক পথ খুঁজে বের করবেন।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা আশা করব, রাষ্ট্রপতি সবার মতামত নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে রাজনীতির আকাশে জমে থাকা মেঘ কেটে যাবে।’
এ প্রসঙ্গে দেশের আরেক বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আমরা সবাই আশা করব, রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগের ফলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং অংশীদারিত্বমূলক নির্বাচন নিশ্চিত হবে।’
রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘এটা ভালো উদ্যোগ। তবে রাষ্ট্রপতি কী জন্য ডেকেছেন, কী বিষয় আলোচনা করবেন, সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি আশা করব, রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগে সবার সম্মতিতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠিত হবে এবং এই ইসির হাতে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতা বিরাজ করছে। এরকম একটি প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি সংলাপ শুরু করেছেন, যা নিঃসন্দেহে শুভ উদ্যোগ।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে অন্তত বরফ গলতে শুরু করবে। রাজনীতির যে বৈরী পরিবেশ ছিল তার অবসান ঘটবে। তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে, রাষ্ট্রপতি কোনোভাবেই সংবিধানের বাইরে যেতে পারবেন না।
তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া আছে। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই রাষ্ট্রপতিকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই রাষ্ট্রপতির কাছে অনেক বেশি প্রত্যাশা করা ঠিক নয়।
তিনি আরও বলেন, ‘তবে এটা ঠিক, কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতিই আমাদের শেষ ভরসাস্থল। তিনিই আমাদের অভিভাবক। বছরের শেষ প্রান্তে এসে তিনি যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছেন, তাতে করে চলমান সংকটের সমাধান আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে শাসক দল উদারতার পরিচয় দিলে এবং রাষ্ট্রপতি যে সিদ্ধান্ত নেন- বিএনপি তা মেনে নিলে সংকট অনেকটাই কেটে যাবে।’
ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রপতি একজন প্রবীন ও ত্যাগী রাজনীতিবিদ। তার আর নতুন করে চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি যেমন সফল, তেমনি মানুষ হিসেবেও সফল। নিয়মের মধ্যে থেকেই তিনি (রাষ্ট্রপতি) সবার মতামত নিয়ে সংকট নিরসন করবেন। একটি ইতিহাস সৃষ্টি করবেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি- রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠন করতে পারেন। তিনি নিজেও সবার কাছে নাম চাইতে পারেন। নামগুলোর মধ্য থেকে কমন নামগুলো তিনি সামনে আনতে পারেন।’
লেখক কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ যুগান্তরকে বলেন, চলমান রাজনৈতিক সংকট দূর করতে একটি নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে আস্থাভাজন নির্বাচন কমিশন গঠন খুবই জরুরি। কারণ নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাই আগামী দিনের নির্বাচন কমিশন কাদের দিয়ে গঠিত হবে তার ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ রাজনীতি।
তিনি বলেন, দুই প্রধান দল বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে। দলের শীর্ষ নেতারাও কেউ কারও সঙ্গে বসতে নারাজ। এমন একটি অবস্থায় রাষ্ট্রপতি সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছেন, যা নিঃসন্দেহে শুভ উদ্যোগ। দেশের মানুষও মনে করে রাষ্ট্রপতিই এখন চলমান সংকট নিরসনের শেষ ভরসা। তবে তিনি (রাষ্ট্রপতি) শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হবেন তা নিয়েও দেশের সচেতন মানুষ সন্দিহান।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের শীর্ষ নেতারা বারবার বলছেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা তারা মেনে নেবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির এককভাবে কিছু করার ক্ষমতা নেই। তিনি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, বা নেবেন না। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়েই তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তিনি বলেন, যদি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়েই রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে এ সংলাপ হবে অর্থহীন এবং লোক দেখানো। দেশের মানুষ এমন অর্থহীন সংলাপ দেখার জন্য বসে নেই। মানুষ চায় সত্যিকারের একটি সফল সংলাপ। যেখানে সব দলের মতামত নিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের রাষ্ট্রপতিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন কমিশনার নিয়োগের বিষয়ে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে তিনি নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। ২০১২ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই ‘সার্চ কমিটির’ মাধ্যমে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এবারও একই পথে হাঁটছেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হবে। এর আগেই নতুন কমিশন গঠন করতে হবে। এর অংশ হিসেবে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। প্রথমদিন রোববার তিনি সংসদের বাইরে থাকা দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সংলাপে বসেন।
পর্যায়ক্রমে তিনি জাতীয় পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সঙ্গে সংলাপে বসবেন। এরপর নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও বসবেন রাষ্ট্রপতি।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।