সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মানবপাচারকারীদের গডফাদার উখিয়া উপজেলার নূরুল কবির ও রেজিয়া আক্তার রেবিসহ (রেবি ম্যাডাম) ১৭৬ জনের অধিকাংশই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। গ্রেফতার এড়াতে তারা চলে গেছেন আত্মগোপনে।
গডফাদাররা আত্মগোপনে গেলেও তাদের অনুসারীদের অনেকেই নিরাপদ দূরত্বে থেকে এলাকায় পর্যবেক্ষণ করছেন। মানবপাচার চক্রের ভয়ে নিখোঁজ স্বজনদের পরিবারগুলো এখনও পুলিশের কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। তাদের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক।
স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও বলছেন, মানবপাচার চক্রের সদস্যরা আত্মগোপনে রয়েছে। এ কারণে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে অপরাধীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং গ্রামের (ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন) নূরুল কবির ও রেজিয়া আক্তার রেবি। সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। স্থানীয়দের কাছে এ দম্পতি মানবপাচারকারীর রাজা-রাণী নামেই পরিচিত। স্বামী নূরুল কবিরের চাইতে তার স্ত্রী রেবির পরিচিতিই এলাকায় বেশী। সবাই তারে ‘রেবি ম্যাডাম’ নামেই চেনেন-জানেন। মানবপাচারের আধিপত্য সুরক্ষিত রাখতে স্বামী-স্ত্রীর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে ‘রেবি ম্যাডাম লাঠিয়াল বাহিনী’।
মানবপাচার করে ওই দম্পতি অঢেল সম্পদের মালিক। তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচারসহ নানা অভিযোগে ডজনখানেক মামলা রয়েছে। পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হয়েছেন তারা একাধিকবার। ২০১৪ সালে ২৩ নভেম্বর স্বামীকে মুক্ত করার জন্য রেবি কক্সবাজার আদালত পাড়ায় তদবিরের জন্য গেলে ডিবি পুলিশ তাকে আটক করে। এ সময় পুলিশ তার ভ্যানিটি ব্যাগে তল্লাশী চালিয়ে ৮৪ লাখ টাকা ও ২৭ লাখ টাকার ২টি ব্যাংকের চেকও উদ্ধার করে। এ ঘটনায় পুলিশ তার বিরুদ্ধে ২টি মামলা দায়ের করে।
অবশ্য আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি ও তার স্বামী। সর্বশেষ চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি রেবিকে মানবপাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন তিনি। উপকূলীয় এলাকায় দাবড়িয়ে বেড়ানো এ রেজিয়া আক্তার রেবির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৫০ সদস্যের একটি শক্তিশালী মানবপাচাকারী সিন্ডিকেট। বর্তমানে স্বামী নূরুল কবির ও রেজিয়া আক্তার রেবি দু’জনেই পলাতক রয়েছেন।
শুধু রেবি ম্যাডাম বা তার স্বামী নূরুল কবির নন, কক্সবাজার জেলা পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব জেলায় ৩৫০ জন মানবপাচারকারীর তালিকা তৈরী করেছে। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে ১৭৬ জনের একটি তালিকা রয়েছে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে জেলার টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলাতেই মানবপাচারকারীর সংখ্যা বেশী। এর মধ্যে শুধু টেকনাফেই মানবপাচারের গডফাদার রয়েছেন ৩১জন। এ তালিকায় স্থানীয় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির নাম শীর্ষে রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মানবপাচার ইস্যুটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে গেলে স্থানীয় প্রশাসন সক্রিয় হয়ে উঠে। র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের যৌথ অভিযানে বেশ কিছু অপরাধীও গ্রেফতার হন। বিশেষ করে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফে ৩ জন ও উখিয়ায় ২ জন মানবপাচারকারী নিহত হওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান বাকীরা।
এদের মধ্যে গডফাদারদের বেশীরভাগই এলাকা ছেড়ে ঢাকা, চটগ্রামসহ অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। আর সাধারণ মানবপাচারকারীরা জেলার মধ্যেই পাহাড়ে বা গহীন-দুর্গম এলাকায় আত্মগোপন করেছেন।
তবে, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মানবপাচার চক্রের গডফাদারদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনেরও গোপন সম্পর্ক থাকায় বরাবরই আড়ালে থাকেন তারা।
মানবপাচার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন হেল্প কক্সবাজারের নির্বাহী পরিচালক আবুল কাশেম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘উখিয়ার তিলছড়ি হাফিজিয়া মাদরাসা থেকে গত দুই মাস আগে ৩ হাফেজ নিখোঁজ হয়েছেন। এদের এখনও খোঁজ মেলেনি। নিখোঁজদের পরিবার এখন পর্যন্ত থানাতেও কিছু জানায়নি।’
তিনি আরও বলেন, “শনিবার (৩০ মে) হাফেজ সাইফুলের বড় ভাই আব্দুর রশীদ ও তার মায়ের সঙ্গে আমার কথা হয়। তারা আমাকে জানিয়েছেন, দালালদের ভয়ে থানায় কোনো অভিযোগ জানায়নি। কেউ কেউ নাকি তাদের বলেছে— ‘থানায় জানিয়ে কী লাভ? ওদের (দালাল) সাথে তো থানা পুলিশের ভাল সম্পর্ক’।”
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা যায়, অবৈধভাবে সাগরপথে বিদেশে যাওয়ার সময় গত ৩ বছর ৪ মাসে কক্সবাজার জেলায় দুই হাজার ৯৪৫ জনকে উদ্ধার করেছে প্রশাসন। একই সময়ে মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে ৩০৬টি এবং এ সব মামলায় আসামী করা হয়েছে এক হাজার ৫৩১ জনকে। এদের মধ্যে আটক হয়েছে ৪৭৭ জন।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান খন্দকার দ্য রিপোর্টকে বলেন, টেকনাফের অধিকাংশ মানুষ এখন ইয়াবা ও মানবপাচারে জড়িত। চলতি মে মাসে ৩১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জনই তালিকাভুক্ত মানবপাচারকারী।’
সাধারণ পাচারকারীরা গ্রেফতার হলেও গডফাদাররা গ্রেফতার হচ্ছেন না কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাঝখানে মানবপাচারকারীদের সঙ্গে আমাদের (পুলিশ) বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। এতে ৩ জন মানবপাচারকারী নিহত হয়। আমিসহ ৪ জন পুলিশ সদস্য আহত হই।’
আতাউর রহমান খন্দকার আরও বলেন, ‘বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার পরপরই তালিকাভুক্ত অপরাধারী আত্মগোপনে চলে গেছে। তাদের মধ্যে কেউ বার্মা (মিয়ানমার), কেউ থাইল্যান্ড চলে গেছে। বাকীরা কক্সবাজার ছেড়ে অন্য জেলায় আত্মগোপন করেছেন। তবে তাদের গ্রেফতারে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।’
কক্সবাজার ডিবির (গোয়েন্দা পুলিশ) ওসি দেওয়ান আবুল হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘চলতি মে মাসে জেলায় ৫০ জনের মতো মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই তালিকাভুক্ত মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানবপাচারকারীদের অন্যতম হোতা রেবিকে আমরা গ্রেফতার করেছিলাম। কিন্তু আদালত তাকে জামিন দিয়েছে। এখন তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। তার মতো আরও যারা মানবপাচারকারী রয়েছে সবাই আত্মগোপনে গেছে। তবে তাদের গ্রেফতারে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।’
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।