আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপোস্টে বিদ্রোহীদের হামলার পর ক্লিয়ারেন্স অপারেশন জোরদার করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তখন থেকেই মিলতে থাকে বেসামরিক নিধনযজ্ঞের আলামত। পাহাড় বেয়ে ভেসে আসতে শুরু করে বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দ। পুড়িয়ে দেওয়া গ্রামগুলো থেকে আগুনের ধোঁয়া এসে মিশতে শুরু করে মৌসুমী বাতাসে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে শূন্যে ছুড়ে দেয় সেনারা। কখনও কখনও কেটে ফেলা হয় তাদের গলা। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় মানুষকে। ওই সহিংসতা থেকে বাঁচতে এ পর্যন্ত ৪ লাখ ২০ হাজারের বেশি মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিপুলভাবে আন্তর্জাতিক পরিসরে নিন্দিত হতে থাকে মিয়ানমার। এক পর্যায়ে তারা আশু পদক্ষেপ হিসেবে ৭টি অাশ্রয় শিবির খোলার কথা জানায়।
গত তিন সপ্তাহে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও পুলিশের হাতে প্রায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় ১ হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান জেইদ রা’দ আল ঘটনাকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞের পাঠ্যপুস্তকীয় দৃষ্টান্ত’ আখ্যা দিয়েছেন। মহাসচিব গুয়েতেরেজ এরআগে প্রশ্ন রেখেছেন, এক তৃতীয়াংশ মানুষ দেশ থেকে উচ্ছেদ হলে তাকে জাতিগত নিধন ছাড়া আর কী নামে ডাকা যায়। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে আইআরআইএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনও এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা আটকা পড়ে আছে রাখাইন রাজ্যে। মাইন পুঁতে রাখা সীমান্ত কিংবা নাফ নদী পেরিয়ে তারা বাংলাদেশে আসতে সমর্থ হয়নি। তাদেরকে ওই ৭ ক্যাম্পে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিয়ানমার।
মিয়ানমার সরকারের একজন মুখপাত্র জো হতাই আইআরআইএন-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাখাইনে নিপীড়নের শিকার হওয়া ওই জনগোষ্ঠীকে বাঙালি বলে উল্লেখ করেন। তিনি জানান, ওই ক্যাম্পগুলো বাঙালিদের জন্য। স্থানীয় আদিবাসীরা তাদের গ্রামে ফিরতে পারবেন। তিনি জানান, রাখাইনে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে কেউ ফিরতে চাইলে তাদেরও রাখা হবে ওই ক্যাম্পে। এদিকে গত সপ্তাহে সরকারের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, রাখাইনের ৪৭১ মুসলিম গ্রামের মধ্যে ইতোমধ্যেই ১৭৬টি গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুড়িয়ে কিংবা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ৭ হাজর বাড়িঘর।
সু চি তার বক্ততায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে শরণার্থী ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি রয়েছে। যে কোনও সময় আমরা যাচাই প্রক্রিয়া শুরু করতে তৈরি আছি। যারা শরণার্থী হিসেবে শনাক্ত হবেন, তাদের ফিরিয়ে নিতে কোনও আপত্তি নেই আমাদের। আইআরআইএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সু চি’র এই দাবির সত্যতা প্রমাণ দুঃসাধ্য। কেননা, বরাবরই রোহিঙ্গাদের কাঠামোবদ্ধভাবে নথিবদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়। এমনকি উপনিবেশিক সীমান্ত ব্যবস্থার আগে থেকে যারা এখানে বাস করছেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সেই মানুষদেরও নথিবদ্ধ করা হয়নি।
রয়টার্সের ২ সেপ্টেম্বর তারিখের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখানকার আশ্রয় শিবিরগুলোতে জাতিসঙঘের ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার কারণে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। রাখাইনে এখনও থেকে যাওয়া রোহিঙ্গারা বিপন্ন অবস্থায় রয়েছেন। জাতিসংঘসহ ২০টি মানবিক সহায়তা দানকারী প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো সরকারের অসহযোগিতা ও বাধাকে কারণ উল্লেখ করে ত্রাণ কার্যক্রম স্থগিত রেখেছিল সেখানে।সীমিত পরিসরে আবারও ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হলেও সেখানে রয়েছে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা। আইআরআইএন-এর প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে ত্রাণকর্মীদের দুর্ভোগের খবর। ওই প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী ত্রাণকর্মীদের ‘রোহিঙ্গা জঙ্গি’ প্রমাণে সরকারি ত্রাণ বণ্টন সংস্থার পক্ষ থেকেই প্রচারণা চালানো হয়। সে কারণে স্বেচ্ছাসেবী হতে ভয় পায় সবাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ত্রাণকর্মী আইআরআইএন-কে বলেন, ত্রাণ বণ্টনকে অসম্ভব করে তুলেছে মিয়ানমার। খোদ রাখাইনের কর্মীদের জন্য এটি ভীতিকর হয়ে উঠেছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেখানকার ত্রাণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রেসক্রসের হাতে তুলে দেওয়া হবে। চিকিৎসা সহায়তা দানকারী আন্তর্জাতিক সংগঠন এমএসএফ বেনয়েট দি গ্রেসে এই পদক্ষেপকে আখ্যা দিয়েছেন নতুৃন কার্যপ্রণালী হিসেবে, যা ত্রাণের সহজলভ্যতাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলবে।
অবশ্য রেডক্রসের পক্ষ থেকে আইআরআইএন রেড ক্রসের কাছে ওই ত্রাণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে মানবিক সহায়তা দানকারী ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়েছে। রেডক্রস বলছে, এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন আশ্রয়শিবিরগুলো নতুন নতুন ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। কর্মক্ষম লাখো মানুষকে নির্ভরশীল করে তুলবে মানবিক সহায়তার ওপর।
আলজাজিরার ১৬ মার্চ তারিখের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে কী করে বাঁচার জন্য একটুখানি খাবার, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা আর শিক্ষার সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও বন্দি জীবন যাপনে বাধ্য হয় রোহিঙ্গারা। সে সময় সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশন ওই শিবিরগুলোতে আটকা থাকা রোহিঙ্গাদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে চলাচল ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মিয়ানমারে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষক নাওরা হাই। রাখাইনের আশ্রয় শিবিরগুলো নিয়ে তার বক্তব্য, রাখাইনের আশ্রয় শিবিরগুলো সুরক্ষা দিচ্ছে না। বরং এগুলো এক একটা উন্মুক্ত কারাগারে রূপান্তরিত হয়েছে।’ তিনি জানান, মানবিক সহায়তা দানকারীদের প্রবেশ সহজ নয় । ক্ষোভ-রাগ-রোগ-মৃত্যু; এগুলোই সেখানকার দৈনন্দিন বাস্তবতা। মানবাধিকার কর্মীদের আশঙ্কা, একটি জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বৃহত্তর কারাব্যবস্থার শ্বেতপত্র হয়ে উঠতে যাচ্ছে শরণার্থী শিবিরগুলো।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।