প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম ভারতের ৮টি রাজ্যেজুড়ে অবস্থান করছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আছেন জম্মুতে। ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন এ কারণে যে, জম্মুতে আশ্রয় নেয়া কিছু রোহিঙ্গা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জিহাদিদের হাতে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এই রোহিঙ্গাদের স্পর্শকাতর অঞ্চলের ভারতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সূত্রগুলো বলেছে, সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জিহাদি কানেকশন রয়েছে। এবং তারা ইতিমধ্যে অন্যান্য দেশে পরিচালিত কিছু হামলায় অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশে যেখানে দেশটি নিজেই অবিরামভাবে তার সব ফ্রন্টে ইসলামি উগ্রপন্থিদের সঙ্গে লড়াই করছে, সেখানে সশস্ত্র রোহিঙ্গারা কথিতমতে চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানে এবং তার কাছাকাছি এলাকায় আক্রমণ সংঘটিত করছে। তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গার উপস্থিতি রয়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশে। যাদের একটি অংশ জিহাদি মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। এ রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের উত্তর-পূর্ব এবং পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আসিয়ান সদস্যরা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গ্রুপ এবং ত্রাণ সংস্থাগুলোর সহায়তায় রোহিঙ্গা সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য মিয়ানামরের প্রতি শক্তিশালী আহ্বান জানিয়েছে। অনেকে মনে করেন, ভারতের উচিত হবে মিয়ানমারকে তার নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধান এবং তার আন্তর্জাতিক মাত্রা প্রসঙ্গে অধিকতর সতর্ক করতে সচেতন করার প্রয়াসে শামিল হওয়া। বাংলাদেশ সরকার যখন দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে হাজার হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে ফেরত পাঠাতে চাইছে তখন মিয়ানমারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা যথারীতি সন্দিহান রয়েছেন। সম্প্রতি মিয়ানমার সরকারের প্রতিনিধি মি. ইউ টিন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর সঙ্গে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু নিয়ে আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশের দুটি স্থানে প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম প্রবেশ করেছে। গত ৮ই অক্টোবরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পরে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হওয়া তীব্রতা লাভ করেছে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সূচির নির্দেশনাক্রমে মি. টিন সম্প্রতি ঢাকা সফর করেন। সন্দেহভাজন রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র আক্রমণে গত অক্টোবরে ৮ মিয়ানমার নিরাপত্তা সদস্যের মৃত্যুর ঘটনার পরে অন্তত ৮৬ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। সেনাবাহিনীর আক্রমণের ঘটনায় বহুসংখ্যক বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এবং সেনা অপারেশনে বহু নারী ও বৃদ্ধ হত্যার শিকার হয়েছেন। এতে ব্যাপকমাত্রায় আরেক দফা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশ ও অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে। সহিংসতা বন্ধে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষসমূহ তাতে সাড়া দিয়েছেন বলে মনে হয় না। অং সান সূচি তার দিক থেকে সেনাবাহিনীর অভিযানকে একটি বিদ্রোহ দমন অভিযানের অংশ হিসেবেই দেখছেন। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো বাংলাদেশও তার সীমান্ত বন্ধ করেছে, যাতে অধিকতর রোহিঙ্গা প্রবেশ করতে না পারে। সাধারণভাবে এসব দেশ উন্মুক্ত সমুদ্রে নৌকাযোগে ফিরে যেতে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করার আগে ন্যূনতম চিকিৎসা এবং অন্যকিছু সুবিধা প্রদান করছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সূচির দূতের কাছে বাংলাদেশের সুবিদিত অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে, মিয়ানমারকেই প্রত্যাবসনের সব দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। তাদের সম্প্রতি সীমান্ত পেরিয়ে আসা এক লাখ রোহিঙ্গাকেই নয়, এর আগে থেকে অবস্থানরত প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নিতে হবে। এর উত্তরে মি. টিন বলেছেন, মিয়ানমার যথাযথ যাচাইয়ের পরেই কেবল কোনো ব্যক্তিকে গ্রহণ করবে। এর অর্থ হলো, তারা যাদের তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে, শুধু তাদেরই গ্রহণ করবে। বাংলাদেশের সরকারি মহল এ মর্মে আস্থাশীল যে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে আগের থেকে অধিকতর সিরিয়াস মনে করছে। মি. টিন একটি অর্থপূর্ণ সফরে এসেছিলেন বলেই গণ্য করছে। বাংলাদেশের সরকারি মহলের এ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যদিও মিডিয়ায় প্রচার করা হয়নি। মিয়ানমারের অতীত অবস্থান এবং পদক্ষেপ বিবেচনায় নিলে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন থেকে যায়। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্রোত অব্যাহতভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর সেটা রাষ্ট্রপরিচালিত পদ্ধতিগত সহিংসতার বাইরে নয়। ১৯৯১-২০০৫ সালের মধ্যে অন্তত দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছে। এরমধ্যে খুবই অল্প সংখ্যক উদ্বাস্তু জাতিসংঘের কাছে তাদের মর্যাদা তুলে ধরতে পেরেেেছ। কিন্তু বাকিরা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের অনুমোদিত শিবিরগুলোতে প্রতিকূল অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। বছরের পর বছর ধরে যে হাজার হাজার রোহিঙ্গা ‘বোটপিপল’ হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে যেতে চেয়েছে, তাদের একটা বড় অংশই সামুদ্রিক ঝড়ে নিশ্চিহ্ন কিংবা গভীর সমুদ্রে অনাহারে মারা গেছে। অব্যাহত আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ এবং বাংলাদেশের প্রচেষ্টার কারণে ২০১৪ সালে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু তখনো মিয়ানামার তা যাচাইসাপেক্ষে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের গ্রহণ করতে রাজি হয়েছিল। এ প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার মাত্র ২৪১৫ জন ব্যক্তিকে গ্রহণ করেছিল। আর অবশিষ্ট হাজার হাজার রোহিঙ্গা আগের মতোই নিরাশার সাগরে ডুবে থাকে। ২০১৫ সালে ৩০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মিয়ানমার যে জরিপ চালিয়েছে, তাতে রোহিঙ্গাদের মর্যাদা আগের মতোই কুয়াশাচ্ছন্ন রাখা হয়। মিয়ানমারের এথনিক উপজাতি নয়, এমন ১৩০টি গ্রুপের যে তালিকা করেছিল, তাতে দেশটির সরকার রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করেনি। তাতে যদি কারো নাম থেকেও থাকে তা বাংলাদেশি হিসেবে, যাতে তাদের পরিচয় দাঁড়ায় রাষ্ট্রবিহীন অনুপ্রবেশকারী। এখন যদি সেই নিয়মেই মিয়ানমারের চলতি নাগরিকত্ব প্রক্রিয়া শুরু করা হয়ে থাকে, তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ঢাকার পক্ষে আশাবাদী হওয়ার তেমন কিছু থাকবে না।
১৮ই জানুয়ারি ভারতের দি ফ্রি প্রেস জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধের অনুবাদ। সুত্র: মানবজমিন
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।