আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা সু চির অবস্থান মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় অবস্থান থেকে একটুও আলাদা নয়। রাখাইন পরিস্থিতিকে রোহিঙ্গা নিপীড়ন নয়, জাতিগত সংঘাত আখ্যা দিয়ে আসছেন তিনি। রাখাইন পরিস্থিতির নেপথ্যে আরাকান আর্মির সন্ত্রাসকেই বড় করে দেখেছেন। সু চি তার ১৯ সেপ্টেম্বরের বক্তব্যে ৩০টি পুলিশ চেকপোস্ট আর একটি রেজিমেন্টাল হেড কোয়ার্টারে সন্ত্রাসী হামলার জন্য রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি এবং এর সমর্থকদের দায়ী করে আইনের আওতায় নেওয়ার হুমকি দেন। সেই বক্তব্যের সমালোচনায় অ্যামনেস্টি বলেছিল, বালুতে মুখ গুঁজে আছেন তিনি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার বিরুদ্ধে এনেছিল সেনাবাহিনীর দমনপীড়ন আড়ালের অভিযোগ।
নতুন করে আবারও তিনি রোহিঙ্গা নিপীড়ন আড়াল করে আরসার সন্ত্রাসী হামলাকে বড় করে দেখেছেন। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার বরাত দিয়ে চীনা সংবাদমাধ্যম সিনহুয়া বৃহস্পতিবার জানায়, বুধবার দেশটির জাতীয় সমন্বয় ও শান্তি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভায় সু চি রাখাইনের যেসব অঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে সেই অঞ্চলগুলোতে সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুনর্বাসন, মানবিক ত্রাণ ও উন্নয়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে তাগাদা দিয়েছেন।
বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী পাঁচটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সরকারি তত্ত্বাবধানে রাখাইন পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়ার একদিন পর এই সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাখাইন পরিদর্শনের সময় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা কার্যালয়ের মন্ত্রী টিন্ট সোয়ে। রাখাইন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ইউ নিয়াই পু সমন্বয় সভায় জানান, সরকার তিনটি ক্ষেত্রে পুনর্বাসনে গুরুত্ব দিচ্ছে। সেগুলো হচ্ছে- তালিকা তৈরি, শরণার্থীদের জন্য খাবার সরবরাহ এবং যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি।
সু’চি এবং মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে ২৫ আগস্টে নিরাপত্তা চৌকিতে আরসার হামলাকে রাখাইন সংঘাতের জন্য দায়ী করা হলেও জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের বুধবারের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে ২৫ তারিখের আগে থেকেই সেখানে জাতিগত নিধনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাখাইন থেকে সব রোহিঙ্গাকে তাড়িয়ে দিতে এবং তারা যেন আর কখনও রাখাইনে ফিরতে না পারে তা নিশ্চিত করতে পরিকল্পিতভাবে সংগঠিত ও কাঠামোবদ্ধ কায়দায় সেনা-প্রচারণা ও অভিযান চালিয়েছে মিয়ানমার।
২৫ আগস্ট রাখাইনে সামরিক অভিযান শুরুর পর বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে পাঁচ লাখ বিশ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। মাঝখানে কয়েকদিন রোহিঙ্গাদের ঢল কিছু মাত্রায় কমে আসলেও চলতি সপ্তাহে তা আবার বেড়েছে। সোমবার বাংলাদেশে প্রায় এগারো হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। জাতিসংঘ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের প্রামাণ্য উদাহরণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। মিয়ানমার সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তাদের দাবি, মুসলিম সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ক্লিয়ারেন্স অভিযান পরিচালনা করছে। রোহিঙ্গা মুসলিমরা নিজেদের গ্রামগুলো পুড়াচ্ছে এবং স্থানীয় রাখাইন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালাচ্ছে।
১৯ সেপ্টেম্বর দেওয়া ভাষণে সু চি দাবি করেছিলেন, রাখাইনে সেনা অভিযান শেষ হয়ে গেছে। সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও রোহিঙ্গাদের নিয়ে কিছু বলেননি। শুধু জানিয়েছিলেন, কেন বাংলাদেশে মুসলমানরা পালিয়ে যাচ্ছে তা অনুসন্ধান করতে হবে। ভাষণে সু চি দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা জাতিগত নিধনযজ্ঞের অভিযোগ নিয়ে কোনও কথা বলেননি।
শান্তিতে নোবেল জয়ী সু চি সামরিক অভিযানের নৃশংসতা নিয়ে নীরব থাকায় আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েন। অবশেষে ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি রাখাইনে সহিংসতা নিয়ে ভাষণ দেন। যদিও ভাষণে সহিংসতার জন্য মুসলিমদের দায়ী করে সামরিক বাহিনীর পক্ষেই অবস্থান নেন এবং সেনা অভিযান সমাপ্ত হয়ে গেছে বলে দাবি করেন সু চি। কিন্তু অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহেও একদিনে প্রায় এগারো হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
এর মধ্যে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি তাদের ক্যাম্পাসে টানানো সু চির প্রতিকৃতি নামিয়ে ফেলে। বেশ কয়েকটি সংগঠন সু চি কে দেওয়া সম্মাননা প্রত্যাহার করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির হুমকি দিয়েছে। সূত্র: সিনহুয়া, গ্লোবাল নিউ লাইটস অব মিয়ানমার।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।