আবদুল আজিজ, বাংলাট্রিবিউনঃ নৌকায় নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের দাবি, জীবন বাঁচাতে নৌকার মাঝি ও দালালদের এই টাকা দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
এদিকে,দালাল চক্র টাকার লোভে প্রতিদিনই রাতের আঁধারে নৌকায় অতিরিক্ত রোহিঙ্গা বহন করছে। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত রোহিঙ্গা বহনের কারণে প্রতিনিয়ত নৌকাডুবির ঘটনাও ঘটছে। এসব নৌকাডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৩৬ জন রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুর সলিল সমাধি হয়েছে।
গত এক সপ্তাহ ধরে নাফ নদী পেরিয়ে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, তাদের প্রত্যেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা নৌকার মাঝি ও দালালদের হাতে দিতে হয়েছে।
নাফ নদীর তীরে দু’দিন অপেক্ষার পর বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা দম্পতি আবুল কালাম ও ফরিদা বেগম জানান, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তারা শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) রাতে নাইক্ষ্যংদিয়া জল সীমানা পয়েন্ট দিয়ে টেকনাফ হয়ে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসেন। তারা জানান, একটি ছোট ডিঙি নৌকায় একসঙ্গে ৪০ রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু নাফ নদী পার হয়ে শাহপরীর দ্বীপে আসেন। এজন্য তাদের মাথাপিছু ১০ হাজার টাকা করে গুনতে হয়েছে। এমনকি টাকা দেওয়ার পরও কিছু রোহিঙ্গা সীমান্তের ওপারে রয়ে গেছেন।
রোহিঙ্গা নারী আলমাস খাতুন জানান, তার স্বামীকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। এ কারণে তিনি সন্তানদের নিয়ে শনিবার রাতে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। এজন্য ছোট সন্তান ছাড়া তাদের জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। আর যারা টাকা দিতে পারেনি, তাদের কানের দুল, বালাসহ সঙ্গে থাকা স্বর্ণালংকার খুলে দিতে হয়েছে দালালের হাতে। তবে কোন দালালকে দিতে হয়েছে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি ওই রোহিঙ্গা নারী।
একই কথা বলেন রোহিঙ্গা যুবক নূর হোসেন। উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি জানান, হোয়াইক্যং উলুবনিয়া ও লম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে তিনি বাংলাদেশে আসেন। এজন্য আলী আকবর নামে এক নৌকার মাঝিকে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে নৌকার মাঝি ও দালালদের বাণিজ্য থেমে নেই। বিশেষ করে টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়া, মৌলভীবাজার, হ্নীলা ও শাহপরীর দ্বীপের কিছু সিন্ডিকেট এসব বাণিজ্য করে যাচ্ছে। প্রতি রাতে এই সিন্ডিকেট রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। লুটে নিচ্ছে স্বর্ণালঙ্কারসহ যাবতীয় আসবাবপত্র।
অভিযোগ রয়েছে, টেকনাফের দক্ষিণ পাড়ার ছলিম উল্লাহ, শামসুল আলম, কবির আহম্মদ ওরফে কবিরা, আলম, ইসলাম, নূর হাকিম মাঝি, আমান উল্লাহ মাঝি, নবী হোসেন, মাঝের পাড়ার কবির মাঝি, মোহাম্মদ হোসেন মাঝি, আমির হামজা, আমান উল্লাহ, করিম উল্লাহ, নজির আহম্মদ, রাজু মিয়া, অসিউর রহমান, মোহাম্মদ আমিন, রহিম উল্লাহ, হাফেজ উল্লাহ, মোহাম্মদ রফিক, মুজিব উল্লাহ, মান্নান, মিস্ত্রী পাড়া গ্রামের লম্বা ছলিম, এনায়েত উল্লাহ, রশিদ আমিন, মোহাম্মদ আমিন, শরিফ হোসেন, নূর হোসেন, নাজির হোসেন, নূরুল উল্লাহ, উত্তরপাড়ার মো. ছৈয়দ, জাবেদ নজির, শামসুল আলম, মোহম্মদ ইলিয়াছ, জিয়াউর রহমান, জালিয়া পাড়া গ্রামের শামসুল আলম, শামীম, প্রকাশ কাসু’র নেতৃত্বে শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়া পাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে প্রতিরাতে ট্রলার ও নৌকা বোঝাই করে রাখাইনের মগনীপাড়া, দামনখালী, ফাদংসা, ফইন্যা পাড়া, সাইরাপাড়া ও নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে নিয়ে আসছে।
এছাড়া, টেকনাফের জালিয়া পাড়ার আকবর প্রকাশ মাইলু শফি আলম, কামাল হোসেন, আবদুল গণি, আবদুর রশিদ, মোহাম্মদ হোছন, সৈয়দ হোসেন, নুর মোহাম্মদ মাঝি, আলম, নুরুল আলম, ফজল করিম, আবু তাহের, নাজির হোসেন, নুর হোসেন, জাগির হোসেন, জামাল, আবদুল্লাহ, আনু মিয়া, আবদুল করিম এ কাজের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।
টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়ায় নাফ নদী সীমান্তের নৌকার মাঝি আলী আকবর জানান, তিনি নাফ নদীতে নৌকা দিয়ে মাছ শিকার করেন। মাছ ধরার সময় অনুরোধ করলে রোহিঙ্গাদের পার করে দেন। তবে জোর করে কোনোদিন টাকা আদায় করেননি। রোহিঙ্গারা খুশি হয়ে যা দিয়েছে, তাই নিয়েছেন।
টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপের দক্ষিণ পাড়ার শামসুল আলম, কবির আহম্মদ ওরফে কবিরা, মো. আলমসহ একাধিক নৌকার মাঝি ও দালালদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে কারও ফোন বন্ধ, আবার অনেকে ফোন রিসিভ না করায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
টেকনাফ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাইন উদ্দিন জানান, নাফ নদীতে যেসব নৌকার মাঝি ও দালাল এই কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অভিযান চলছে। গত এক সপ্তাহে ১২ জন নৌকার মাঝি ও দালালকে আটকের পর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয়েছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।