গত ২৪ আগস্ট আনুমানিক পৌনে ৩টার দিকে আমার মোবাইল ফোনটি বেজে উঠে। রিসিভ করতে অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। কিন্তু, কেন হচ্ছে আমার সোর্স তা জানেন না। তার ধারণা, বিজিবি-বিজিপি’র মধ্যে এই গোলাগুলি হতে পারে। তবে এমন গুলির শব্দ হচ্ছে যে মনে হচ্ছে তার বাড়ির পাশেই চলছে গোলাগুলি। আমি তাকে অভয় দিলাম। রাতে শব্দ এমনই হয়। চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। অবশ্য, আমি আমার সেই সোর্সের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, তখন আমারও কানে ভেসে আসছে গুলির শব্দ। ঘটনাটি রাতে হওয়ায় শব্দটি একদম পরিষ্কার করে শোনা যাচ্ছে সীমান্তের এপারে। এজন্য সীমান্তে বসবাসকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘুম ভেঙে যায় সীমান্তবাসীদের। অনেকে রাস্তাঘাটে, দোকানে ও বাসাবাড়িতে জড়ো হয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে এবং আতঙ্কে রাত অতিবাহিত করে। তবে সেই আতঙ্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
ওই দিন মধ্যরাতে সোর্সের এই খবরটি আমাকে বিচলিত করে তোলে। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এত রাতে বিজিবি এবং পুলিশকে ফোন দেওয়া কি ঠিক হবে? আর কেনই বা তারা আমার ফোন রিসিভ করবেন? নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। কেন এত গোলাগুলি? আর এত রাতে অফিসকে বলেও কী লাভ, যদি বিষয়টি নিশ্চিত করতে না পারি? সাত-পাঁচ চিন্তা করে কোনও উপায় খুঁজে পেলাম না। পরে বাধ্য হয়ে কক্সবাজারের ৩৪ বিজিবি’র অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মনজুরুল হাসান খাঁনের মোবাইল ফোনে কল দিলাম। ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা রিসিভ করে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন কী জানতে চান দ্রুত বলুন। আমি তাকে সরাসরি প্রশ্ন করলাম সীমান্তে গোলাগুলি হচ্ছে। কার সঙ্গে এবং কেন বা কী কারণে হচ্ছে।আমার প্রশ্নের সব উত্তর এক মিনিটের মধ্যেই শেষ করলেন তিনি। তিনি আমাকে বলেছেন, জানতে পেরেছি মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সে দেশের পুলিশ পোষ্টে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সীমান্তরক্ষী পুলিশের সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হচ্ছে। এতে সীমান্তে বসবাসকারীদের ভয়ের কোনও কারণ নেই। সীমান্তে বিজিবির সদস্যরা সতর্কবস্থায় রয়েছে। এরপরও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। তার সঙ্গে কথা বলার পর বিষয়টি আমার সোর্সকেও অবহিত করলাম। কারণ সীমান্তে তারা খুবই আতঙ্কে রয়েছে।
এরপর রাতে আর ঘুমাতে পারলাম না আমি। আমার মনে হলো, সকাল থেকে হয়তো সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল নামবে। এজন্য সীমান্তে বসবাসকারী আমার সোর্সদের কাছে একের পর এক ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে চলছি। দুই-একজনকে ফোনে পাওয়া গেলেও অনেককে পাওয়া যাচ্ছিল না। সীমান্তে নেটওয়ার্ক সমস্যা তো রয়েছে তার ওপর অনেক স্থানে বিদ্যুৎ নেই। সকালে রাখাইন রাজ্যে পরিচিত কিছু সোর্সের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ হয়েছে। তারাও বলছেন, রাখাইনের পরিস্থিতি থমথমে। কী হতে যাচ্ছে তারাও ভেবে পাচ্ছে না। হয়তো সেখানে তাদেরও মৃত্যু হতে পারে।
পরের দিন ২৫ আগস্ট সকালে সীমান্তের পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছিল না। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে অতিরিক্ত বিজিবি সদস্য মোতায়েন করে সতর্কবস্থায় রেখেছে প্রশাসন। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়েছে। কোনও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেনি। বিজিবি’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে কোন রোহিঙ্গাকে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। এসময় বাংলা ট্রিবিউন-এর হেড অব নিউজ হারুন উর রশীদ (হারুন ভাই) এর ফোন। জানতে চান সীমান্তের খবরাখবর। আমাকে অ্যালার্ট থাকার পরামর্শ দেন। ওই দিন দুপুর গড়িয়ে বিকাল আসতেই আমার মোবাইল ফোন আরেকবার বেজে উঠলো। টেকনাফের লম্বাবিল সীমান্তে আমার এক ছোট ভাই বলছেন, ভাইয়া রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করেছে এবং বাংলাদেশেও অনুপ্রবেশ করেছে। নিশ্চিত হতে তার কাছে ওদের ছবি চাইলাম। সে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কিছু ছবি তার মোবাইল ফোনে তুলে আমার ম্যাসেঞ্জারে পোস্ট করলো। অবশ্য, এসময় আমাদের সীমান্তরক্ষী বিজিবি’র পক্ষ থেকে অনুপ্রবেশের বিষয়টি বার বার অস্বীকার করা হচ্ছিল।
তবে আমি থেমে থাকিনি। আমার ম্যাসেঞ্জারে পাঠানো সেই ছবি এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে ছোট একটি স্টোরি আমার বাংলা ট্রিবিউন অফিসে পাঠালাম। বলা যায় এবারের রোহিঙ্গা সংকটের সংবাদ পাঠানোর সেই হচ্ছে শুরু। এরপর আর বসে থাকার সুযোগ নেই। বাংলা ট্রিবিউনে দুই মাস ধরে পাঠিয়ে যাচ্ছি রোহিঙ্গা সংকটের সব খবর।
সেই দিনের কথা আবারও বলছি। সীমান্তে রাতের চিত্র ভয়াবহ। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের টেকনাফের লম্বাবিল, উলুবনিয়া সীমান্ত থেকে শুরু করে উখিয়ার রহমতের বিল, ঝিমনখালী ও নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম, তুমব্রু সীমান্তে রোহিঙ্গাদের স্রোত আসতে শুরু করে। সকালেই চলে যাই সীমান্তে। সঙ্গে ছিলেন বৈশাখী টিভির কক্সবাজার প্রতিনিধি আমার সহকর্মী নেছার আহমদ। দুজনই সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে যার যার মতো করে ছবি ও ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করতে থাকি। একদিকে সংবাদ কাভার করতে গিয়ে আমাকে হিমশিম খেতে হয়েছে। সীমান্তে কঠোর পরিশ্রম করেও ঠিক মতো সংবাদ পাঠানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। মোবাইল নেটওয়ার্ক আমাদের ভোগান্তি দেয়। এরপর দেশি মিডিয়া ছাড়াও আন্তর্জাতিক একাধিক মিডিয়া সীমান্তে কাজ শুরু করে দেয়। আমিও আমার মতো কাজ করতে থাকি।
পরিবহন ভাড়া চিন্তা না করেই ২৬ আগস্ট আবারও সীমান্তে চলে যাই। তখন সীমান্তের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া ভেদ করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে। সরকারের ওপর মহলের নির্দেশ না পাওয়ায় বিজিবির সদস্যরা তাদের আটকানো চেষ্টা করে। কিন্তু, কতজনকে বাধা দেবে বিজিবি। তারাও অসহায় হয়ে পড়ে। এরপরও সীমান্তের নো-ম্যান্সল্যান্ডে মানবিক সহায়তা দিয়ে তাদের আপাতত অবস্থানের সুযোগ করে দেয়া হয়। এসময় নো-ম্যানস ল্যান্ডে হাজার হাজার রোহিঙ্গা আটকা পড়ে এবং পানি ও খাদ্য সংকট দেখা দেয়। হাজারো রোহিঙ্গার আর্তনাদ ও শিশুদের কান্নায় আকাশ ভারি হয়ে উঠে। এসময় দায়িত্ব পালনরত অনেক বিজিবি সদস্যকে আমি কাঁদতে দেখেছি। কিন্তু, সরকারি নির্দেশ না পাওয়ায় তাদের এদেশে ঢুকতে দেওয়ার উপায় ছিল না।
দেশবাসীকে এ পরিস্থিতি জানাতে একের পর এক প্রতিবেদন তৈরি করতে থাকি। আমার শ্রম আর বিষয়টির গুরুত্ব ততক্ষণে বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষের কাছে ‘টপ প্রায়োরিটি’ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা পাঠাচ্ছি তাই কাভার স্টোরি হয়ে যাচ্ছে। পাঠকও পড়কে গোগ্রাসে। সবাই জানতে চাইছে কী ঘটছে উখিয়া ও আশেপাশের সীমান্তগুলোতে। অফিস থেকে হেড অব নিউজ হারুন উর রশীদ ও ন্যাশনাল ইনচার্জ ফৌজিয়া সুলতানার নানা নির্দেশনা, পরামর্শ ও উৎসাহ আমাকে কাজ করার অনুপ্রেরণা জোগায়। অ্যাসাইনমেন্ট কাভারে গিয়ে তাদের দেওয়া নানা কৌশল পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজে লাগিয়েছি। এখন মনে হয়েছে, সীমান্তে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমি অনেক কিছু জেনেছি এবং শিখেছি। কারণ এটি একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু। এই ইস্যুতে সাংবাদিকতা করা সত্যিই দুরূহ কাজ ছিল। যদিও অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করেছি। জেনেও না জানার চেষ্টা করেছি। কারণ, আগে দেশের সার্বভৌমত্ব। দেশ এবং জাতি। এরপর সাংবাদিকতা।
রোহিঙ্গা ইস্যুর দুই মাস পূর্ণ হয়েছে। এই দুই মাসে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পার করতে হয়েছে আমাকে। নিরলস পরিশ্রম করেছি। সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্যাম্প এবং সীমান্তে চলে যাওয়া এবং সন্ধ্যায় শহরে বাসায় ফিরে আসা। আবার বাসায় ফিরে রাত জেগে নিউজ লেখা। এরমধ্যেই আমার এক বছরের সন্তানটি অনেকবার ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছে। আমার স্ত্রীকে কতবার ডাক্তারের দরজার কড়া নাড়তে হয়েছে এর কোনও হিসেব নেই। এই দুই মাসে নিজের গ্রামের বাড়ির সামনে দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করলেও সংবাদ সংগ্রহ ও দ্রুত পাঠানোর চ্যালেঞ্জের কারণে একবারও নেমে বাবা-মাকে দেখে আসতে পারিনি। মনে এত কষ্ট ও এত বেদনা নিয়েই তো সাংবাদিকতা। এরপরও আমি ভালো আছি। আজ আমি সবচেয়ে কৃতজ্ঞ সীমান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমার সোর্সদের প্রতি। তাদের সহযোগিতা না পেলে সবার আগে সব সংবাদ অফিসে পাঠানো সম্ভব হতো না। সোর্সরাই আমার ভালবাসা, সোর্সই আমার প্রাণ…..।
লেখক: বাংলা ট্রিবিউনের কক্সবাজার প্রতিনিধি।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।