মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর,এডভোকেট
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরগুলোতে মোট পরিবার রয়েছে প্রায় ২ লাখের মতো। এর মধ্যে ৩ শতাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১০ জনের বেশী। ১০ শতাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৮ থেকে ৯ জন। ২৩ শতাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৬ থেকে ৭ জন। ২৮ শতাংশ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১ থেকে ৩ জন। গড়ে প্রতি পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫জন। আশ্রয় শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৫২ শতাংশ শিশু। তাদের বয়স শূন্য থেকে ১৭ বছর। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে বসবাস করছে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা। আশ্রয়শিবিরগুলোর বেশীর ভাগ উখিয়া কুতুপালংয়ে। যেটাকে বলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ আশ্রয়শিবির। যেখানে ছোট একটি এলাকার মধ্যে ৭ লাখের বেশী রোহিঙ্গা বসবাস করছে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয় জানিয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে প্রায় এক শত শিশু। গেল ৬ বছরে জন্ম নিয়েছে প্রায় ২ লাখ শিশু। ক্যাম্পে দায়িত্বরত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, পরিবার-পরিকল্পনা সম্পর্কে অনাগ্রহ,রেশন বৃদ্ধি ও ক্যাম্প জীবনে তেমন কোন বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় বেশী সন্তান জন্মদানের মূল কারণ।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর প্রায় ৮ লাখ,আগে আসা ও নতুন করে জন্ম নেওয়া প্রায় দুই লাখ সহ বাংলাদেশে এখন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। ঐ বছরই চীনের বিশেষ অতি আগ্রহে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকার তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশের সাথে তিন মাসের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক প্রত্যাবাসন চুক্তি করলেও বিগত ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার। তালিকা দেওয়া, তালিকা নেওয়া, যাচাই বাছাই ইত্যাদি অজুহাতে পরিকল্পিতভাবেই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কাজ শুরুই করতে দেয় নি। সেই বছর দ্বিপাক্ষিক চুক্তির সাথে সাথে আমরা দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় লিখেছিলাম চীনের বিশেষ আগ্রহে মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে প্রত্যাবাসন চুক্তি করেছে বিশ্ব-বিবেককে ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নেওয়ার অপকৌশল হিসেবে।
রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে আর্ন্তজাতিক অপরাধ আদালতে বিচারাধীন মামলায় চাপ কমানোর জন্য বা মিয়ানমারের মোটিভ ভাল তা দেখানোর জন্য সম্প্রতি চীনাদের সাহায্যে পাইলট প্রকল্পে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেছেন। রোহিঙ্গা নেতাদের মিয়ানমারের পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও পুর্নবাসন প্রস্তুতি সরেজমিনে দেখানোর জন্য মিয়ানমার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের দেওয়া তালিকা থেকে ৪২৯জন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে মাত্র ৭১১জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার সম্মতি দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমার ও চীনের পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্বিপাক্ষিকভাবে প্রতি মাসে ১০০০ জন করে রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন শুরু করলে বছরে ১২০০০ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব। কিন্তু প্রতি বছর ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে প্রায় ৩০হাজার রোহিঙ্গা সন্তান। বছরে মোট ১২ হাজার রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিলেও নতুন জন্ম নেওয়া ৩০ হাজারের মধ্যে আরো ১৮ হাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থেকে যাচ্ছে এবং মোট সংখ্যা প্রতি বছর আরো বৃদ্ধি পাবে। তা হলে বর্তমানে বাংলাদেশে থাকা ১৪ লাখের সাথে আরো কয়েক লাখ জন্ম নিলে হাজার বছরেও বাংলাদেশে আশ্রিত সকল রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরৎ নেওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই।
রোহিঙ্গারা প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি নিয়ে তালিকা করে তালিকা যাচাই বাছাই করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা আসেন নাই। প্রাণ বাঁচানোর জন্য যে যেভাবে পারেন সেভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা যেভাবে বাংলাদেশে এসেছেন সেভাবেই আবার মিয়ানমারে চলে যাবেন। এত তালিকা করার,যাচাই বাছাই করার, প্রতিনিধি দল আসা-যাওয়ার দরকার কি? শুধু সময়ক্ষেপন করা। এইখানে রোহিঙ্গাদের বসবাস দীর্ঘায়িত করা বা স্থায়ী করা।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ বন্ধের আহŸান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মিয়ানমারের পরিস্থিতিবিষয়ক বিশেষ র্যাপোটিয়ার টম অ্যান্ড্রুস। তিনি বলেছেন,মিয়ানমারে রাখাইনে এখনো রোহিঙ্গাদের জীবন ও চলাচলের স্বাধীনতা ঝুকিতে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও বিবৃতি দিয়ে বলেছে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমার ফিরে যাওয়া নিরাপদ নয়।
ঠিক ছয় বছর আগে ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নারকীয় নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে রাখাইন রাজ্য থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী,পুরুষ ও শিশুদের ঢল নেমেছিল বাংলাদেশে। এই দিনটি স্মরণ করে সম্প্রতি গণহত্যা দিবস পালন করেছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে সমাবেশ করে হাজার হাজার আশ্রিত রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা এফডিএমএন রিপ্রেজেনটেটিভ বোর্ড মেম্বার মাস্টার ছৈয়দ উল্লাহ ঘোষণা করেছেন,আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমরা আরো জোর দাবি জানাবো। এর পরও যদি আমাদেরকে নিজের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে না যায় তখন আমরা আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা নিয়ে বর্ডার ভেঙ্গে আমাদের দেশ মাতৃভুমি মিয়ানমারে ঢুকে যাবো।
একইভাবে এই বছর ২০২৩ এর জুন মাসেও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ ক্যাম্প এলাকায় শোভাযাত্রা ও মানববন্ধন করে নিজেদের ভাষায় জনপ্রিয় গানের সুরে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আকুতি জানিয়ে ’গো হোম’ কর্মসুচি পালন করে চারটি শর্ত দিয়েছেন। শর্তগুলো হলো, রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নাগরিকত্ব দিতে হবে; রাখাইন রাজ্যে ফেলে আসা জন্মভিটাতে তাদের পুনর্বাসন করতে হবে; স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ দিতে হবে এবং রোহিঙ্গাদের লুন্ঠিত সম্পদ ও জায়গা-জমি ফেরত দিতে হবে। সবগুলো দাবীই অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত,আর্ন্তজাতিক আইন ও সার্বজনিন মানবাধিকারের সাথে সংগতিপূর্ণ।
আপাততঃ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিজ জন্মভিটাতে ফিরে গিয়ে নতুন করে আবাসন তৈরী করে স্বাধীনভাবে কৃষিকাজ,ব্যবসা-বাণিজ্য এবং নিরাপদে চলাচল করার স্বাধীনতা দিয়ে মিয়ানমার সরকার একটি ঘোষণা দিলেই আশ্রিত রোহিঙ্গারা নিজেদের উদ্দ্যোগে স্বেচ্ছায় তাদের মাতৃভুমি মিয়ানমারে চলে যাবেন ।
আমরা কক্সবাজারের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ মিয়ানমার-চীনের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথিত ’পাইলট প্রকল্পের’ পিছনের শুভঙ্করীর ফাঁকি বুঝতে পারলে আমাদের সরকার ও আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় তা বুঝতে পারবেন না কেন?
লেখক : সাবেক সভাপতি ও পিপি, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি ও একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।