মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ সদস্যরা গুপ্তচর দিয়ে গোপনে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের তথ্য সংগ্রহ করছে। নানা কৌশলে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে তাদের এজেন্ট নিয়োগ করা হচ্ছে। টেকনাফস্থ কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে এক রোহিঙ্গা সোর্সকে আটক করার পর এ ব্যাপারে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। সে সোর্স মিয়ানমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের কাজ করছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি সরকারের একটি বিশেষ কমিটি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে মিয়ানমারের গোয়েন্দাগিরি সম্পর্কে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। সে প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে গোয়েন্দাগিরি সম্পর্কে নানা তথ্য তুলে ধরা হয়।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার সরকার সীমান্তের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য গুপ্তচর পাঠিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে। তারা সীমান্তে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের নিয়ে গুপ্তচরদের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে দমনপীড়ন চালায় বলে খবর পাওয়া যায়। শুধু তাই না, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় বড় ধরনের যৌথ অভিযান চালানোর চিন্তাভাবনা ছিল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য মিয়ানমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর (সেনাবাহিনীর) উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কমান্ডো গুপ্তচর হিসেবে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল।
সূত্র জানায়, গত বছর ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের অভ্যন্তরে নাগকুরা, সিকান্দি, কাউয়ারবিল, বুচিডং, সিতারাপুরিখা, রাথিডং এলাকায় মিয়ানমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী (বিজিপি) ৮ থেকে ১০টি ক্যাম্পে একযোগে সন্ত্রাসী হামলা চালায়। হামলায় বিভিন্ন পদ মর্যাদার বিজিপির কয়েকজন সদস্য নিহত ও অনেকেই আহত হয়েছে। ওই সময় সন্ত্রাসীরা ৫০ থেকে ৬০টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়। এরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাংলাদেশ মিয়ানমার মধ্যকার চলাচল বন্ধ করে দেয়। মিয়ানমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মন্ডু হতে প্রায় ২ কিলোমিটার পূর্বদিকে কাওয়ার বিল এলাকায় কান্দিরাপাড়া, শনবনিয়াপাড়া ঘেরাও করে নির্বিচারে গুলি করে। এতে ৯ রোহিঙ্গা নিহত হয়। এরপর মন্ডু এলাকায় কারফিউ জারি করে জনসাধারণকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করে। উক্ত অভিযানে ১ জনকে গুলি করে হত্যাসহ ৩টি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এরপর মন্ডু থানার কান্দাপাড়া থেকে ৭ ব্যক্তিকে ধরে গুলি করে হত্যা করা হয়। আর নারীবিল এলাকায় ৩ রোহিঙ্গাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। আর ৭ মহিলাকে ধরে নিয়ে যায়। ওই সময় ভারী অস্ত্র দিয়ে ফায়ার করার শব্দ শোনা গেছে। এসব ঘটনার পর নাফ নদীর জৈল্লার দ্বীপে বিপরীতে মিয়ানমার লাল দ্বীপে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৪টি স্পিটবোর্ট দিয়ে তল্লাশি চালায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গত অক্টোবর মাসে মিয়ানমার কাদিরবিল গ্রামে অভিযান চালিয়ে ৫০০ বাড়িঘর ধ্বংস করে। ওই সময় উক্ত গ্রামের লোকজন ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আশপাশের এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। ওই সময় নাড়বিল নামক স্থানে মগ সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বাড়িতে ঢুকে মালামাল লুট করে। আর মেয়েদের ধরে নিয়ে ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। মিয়ামানমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় ২২টি ঘরে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করছে। তখন মিয়ানমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৪৮ রোহিঙ্গাকে আটক ও ১২ নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে বলে অসমর্থিত সূত্র জানিয়েছে।
এসব তান্ডবের পর মিয়ানমার রাখাইন স্টেটে সব ধরনের এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের কার্যক্রম ও চলাফেরা স্থগিত করা হয়। এভাবে মিয়ানমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও আগুন লাগিয়ে তান্ডব চালিয়েছে। হামলা ও তান্ডবের সময় হেলিকপ্টারে উড্ডয়ন ও দেবিনা ক্যাম্পে অবতরণ করে। তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেলিকপ্টার একপর্যায়ে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় প্রবেশ ও অবতরণ করেছিল। অবশ্য তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করলে তারা দুঃখ প্রকাশ করে। এভাবে মিয়ানমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর তান্ডব, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে। আর আকাশপথে হেলিকপ্টারে টহল দিয়েছিল। তখন রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্যাপক তল্লাশি চালানো হয়েছিল। এসব তান্ডবের পর মিয়ানমার সীমান্তে বাংললাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাম্পসমূহে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। আর মিয়ানমার এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অংশ নেয়া অস্ত্রবাজরা যাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে তার জন্য তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে বাংলাদেশি জেলেদের নাফ নদীতে মাছ ধরার ওপর ওই সময় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
গত বছর অক্টোবর মাস থেকে মিয়ানমার রোহিঙ্গা ও নিরাপদ সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে নির্যাতন, হত্যা, লুটপাটের নানা তথ্য পাঁচ ডৃষ্ঠার গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে গোয়েন্দা টিম তাদের কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠিয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষায় আরও সতর্কতা অবলম্বন করছে। একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে ঢুবে গুপ্তচরদের সম্পর্কে সজাগ রয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করা হযেছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থী এলাকায় অপরাধ দমনে পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে বলে জেলা পুলিশ সূত্র জানিয়েছেন।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।