একটি শিশুকে গাড়ি দুর্ঘটনা থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে একজন পুলিশ সদস্য শের আলীর মানবপ্রেমের বিরল দৃশ্যটি বিশ্বজুড়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়িয়ে পড়া শের আলীর ৪ টি ছবি বাংলাদেশের প্রধান সারির গণমাধ্যমসহ বিশ্বের অনেক গণমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছে । এই নিয়ে বিশ্বজুড়ে মানবতাবাদের এক শিহররণ জেগে উঠেছে। সেই সাথে বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগ আলাদা উপস্থাপনে আবর্তিত হয়েছে। পুলিশকে যারা খুব ঘৃণার চোখে দেখতেন তারা সে অবস্থান থেকে একটু হলেও সরতে বাধ্য হয়েছেন! তারা মানতে বাধ্য হয়েছেন, সব পুলিশ এক রকম নয়। সব মিলে এই ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশ আর পুলিশকে মানবতাবাদের এক উচ্চমার্গে উপনীত করেছেন শের আলী।
বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই ছবি গুলো তুলে নিজের ফেইসবুকে দিয়ে আলোড়ন তুলেছেন যমুনা টিভির কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি ইমরুল কায়েস। ইমরুল কায়েস ছবিগুলো তুলে তার ফেইসবুকে না দিলে হয়তো অজানাই থেকে যেতে শের আলীর মতো মহৎ মানুষেরা। শের আলীর ছবি নিয়ে শনিবার রাত ১২টা ৫২ মিনিটে ইমরুল কায়েষ তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন – এই হলো মানবতা , আজ কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাত্রীবাহি বাস নিয়ন্ত্রন হারিয়ে উল্টে গেলে বাসের নিচে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে তিন ঘন্টা চাপ পড়ে থাকে ছোট্ট শিশুটি। অনেক চেষ্টার পর সেনাবাহিনীর সহযোগিতা রক্তাক্ত শিশুটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালের নেয়ার জন্য দৌড়ানো শুরু করে স্থানীয় বাসিন্দার পুলিশ সদস্য শের আলী। অপরিচিত এই শিশুটিকে বাঁচানোর জন্য তখন চিৎকার করে কাঁদতে থাকে চট্টগ্রাম ডিবি পুলিশে কর্মরত শের আলী। শের আলীর কান্না দেখে উপস্থিত হাজার হাজার জনতাও চোখের পারি ধরে রাখতে পারেনি। শের আলী আর হাজারো মানুষের দোআ আর কান্না আল্লাহ কবুল করেছেন। শিশু উম্মে হাবিবা এখন আশংখা মুক্ত। এই হলো মানবতা।। জয় হোক মানবতার।
রামুর রশিদনগরে শনিবার দুপুরে র্দূঘটনার পরপর ঘটনাস্থলে বেশ কিছু সাংবাদিকের পাশাপাশি অনেক সাধারণ মানুষও মুঠোফোনে উদ্ধার কার্যক্রমের ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিলেন। এই যেন ছবি তোলার প্রতিযোগিতা! সবাই শুধু দেখিয়ে দিয়েছিলেন ক্লিকের বাহার! ছবি তোলার কারনে ব্যাহত হচ্ছিল উদ্ধার র্কাযক্রম। মাইক দিয়ে বারবার ঘোষনা দেয়ার পরও বন্ধ হচ্ছিলোনা হাজারো মানুষের ছবি তোলা। হাজারো মোবাইল ক্যামেরায় তোলা হচ্ছে অসংখ্য ছবি। কিন্তু শের আলীরা বুঝি সবার চোখে ধরা পড়ে না! একটি দৃশ্যপটের ছবি শত শত ক্লিকারদের মোবাইল-ক্যামেরায় বন্দি হয়েছে। কিন্তু শের আলীর দৃশ্যটি একমাত্র একজন অনুসন্ধিৎস্যুর চোখে আটকে ছিলো! তিনি হলেন সাংবাদিক ইমরুল কায়েস চৌধুরী।
এ ব্যাপারে ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, ‘রামু বাস দুর্ঘটনার ঘটনাস্থলে গিয়ে আমার অনুসন্ধিৎস্যু চোখ ভিন্ন কিছুর খোঁজে ব্যস্ত! উদ্ধার কার্যক্রমের অনেক ছবি তুলে ফেলেছি। এক পর্যায়ে দেখি, এক ব্যক্তি ছোট্ট একটি মেয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে দৌড়ে আসছেন। আমি মনে করেছি নিশ্চয় তিনি মেয়েটির বাবা। তারপরও দৃশ্যটির ভিন্নমাত্রা রয়েছে- এই অনুভূতি থেকে আমি বাবা-মেয়ের (!) এই মন কাঁদানো দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দি করে নিই। প্রায় ১০ মিনিট পর দেখি লোকটি আবারো উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। আমিতো অবাক! নিজের ছোট্ট মেয়েকে মুমূর্ষু অবস্থা ফেলে আবার তিনি এখানে কেন? তাকে প্রশ্নটা করে বসি। তখনই শের আলী দিলেন ভিন্ন একটি জবাব।
ইমরুল কায়েস চৌধুরী জানান, শের আলী মেয়েটির বাবা ছিলেন না। তিনি মানবতাবোধ থেকে উদ্ধার কার্যক্রমের অংশ নিয়ে মুমূর্মু মেয়েটির ‘আব্বু’ ডাকে নিজের আর ধরে রাখতে পারেননি। ‘আব্বু’ শুনেই তার কোমল মনটা হু হু করে কেঁদে উঠে- যা দু’চোখে অশ্রুর বান তুলে!
ইমরুল কায়েস বলেন, এই বিষয়টি জানার পরই ঘটনাটি আমার কাছে অত্যন্ত ব্যতিক্রম মনে হলো। এমন ঘটনাতো খুব কমই আছে! তখনই ক্লিক করা দৃশ্যটি আমার কাছে বিশেষ হয়ে ধরা দেয়। একজন মানুষ এত কোমল ও হৃদয়গ্রাহী কিভাবে হতে পারে? এই কৌতুহল থেকে আমি ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করি। পোস্ট করেই বুঝতে পারি সত্যিই ঘটনাটি বিরল।
যমুনা টিভির কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি ইমরুল কায়েস চৌধুরী জানান, তার সাংবাদিকতার বয়স খুব বেশি সময় হয়নি। তবে সাংবাদিকতার শুরু থেকে, বিশেষ করে ছবির তোলার ক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু খুঁজতেন তিনি। এই ভিন্ন চোখে অতীতে তিনি কিছু ব্যতিক্রম ছবি তুলেছেন যেগুলো অনেক জায়গায় সমাদৃত হয়েছে। একটার ছবির জন্য ৫০ হাজার সম্মানিও পেয়েছিলেন। তবে ভিন্ন ছবি তুলতে গিয়ে অনেক রোষানলেও পড়েছেন। এই প্রসঙ্গে ফেসবুক ওয়ালে (মিস্টার চৌধুরী) অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি ‘শের আলীর কান্না ও আমার ছবি’ শিরোনামে লিখেছেন, আমার এক ছবিতেই কেঁদেছে পুরো বাংলাদেশ। এক ছবি পাল্টে দিয়েছে পুলিশের ভাবমূর্তি। একটি ছবি কতোটা শক্তিশালী হয় তা সারা বিশ্ব দেখেছে। একজন সাংবাদিকের জীবনে এই ধরনের ছবি তোলার সুযোগ সবসময় আসে না। অল্প কদিনের সাংবাদিকতায় এই ধরনের ছবি তুলতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি।
ইমরুল কায়েস চৌধুরীকে নিয়ে ৭১ টেলিভিশনের কামরুল ইসলাম মিন্টু তার ফেইসবুককে লিখেছেন, খুব ভয় পেতাম। হাতে থাকা ক্যামেরা নতুবা সেল ফোন নিয়ে যখন তখন অন্যের ছবি তুলে মজা কিংবা ব্যাঙ করার অভ্যাস তাঁর। এমন আচরণ নিয়ে বিব্রতও হতেন অনেকেই। তবে অল্প সময়ের অভিজ্ঞতায় ক্যামেরার ফ্রেমে বিশেষ সৌন্দ্যর্য ফুটিয়ে তুলতেও পটু তিনি। রোববার পানিরছড়া সড়ক দূর্ঘটনায় বন্ধু লিপু ও আমি যখন সংবাদ সংগ্রহে ঘটনাস্থল পৌঁছলাম তার আগে যমুনা টেলিভিশনের ইমরুল ভাই ঘটনাস্থলে এলোপাতাড়ি ছবি তুলছেন। এমনকি আমি আর লিপু যখন সেলফির মতো করে স্কাইপি লাইভ দিচ্ছিলাম। তখনও আমাদের করুণ দশার ছবি তোলা শুরু করলেন ইমরুল ভাই। সত্যি কথা খুবই বিব্রত ও লজ্জাবোধ হচ্ছিল তার এমন আচরণে। কিন্তু কে জানতো ইমরুল ভাইয়ের এমন ছেলেপনার ভেতর থেকে মানবতা জাগানিয়ার ছবি সৃষ্টি হবে। যে ছবি দেশের প্রান্ত ছুঁয়ে মানব পাঁজরে ঝাঁকুনি দিবে। কাজ শেষে রাতে যখন ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম তখন, ছবি গুলো দেখাতেই আমি বললাম, ভাই ছবি গুলো পোষ্ট করে দেন। সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি এফবি জুড়ে হৈ ছৈ। শের আলীর শিহরণী মনুষ্যত্ববোধকে তুলে এনে নুয়ে পড়া মানবতাকে জাগিয়ে দেবার জন্য আপনাকে স্যালুট। আপনার ছবিতে আর কখনো বিব্রত হবোনা মিস্টার চৌধুরী ভাই ।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।