কক্সবাজার সময় ডেস্কঃ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় সত্যিকারের নেতা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে তিনি যে সহমর্মিতা ও সমানুভূতি দেখিয়েছেন তা অনন্য। নিউজউইক, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, খালিজ টাইমসসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অকুণ্ঠ প্রশংসা করা হয়েছে। খালিজ টাইমস প্রাচ্যের নতুন তারকা হিসেবে অভিহিত করেছে শেখ হাসিনাকে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড হ্যাজ আইডিওলাইজড অং সান সু চি, বাট দ্য হিরো অব দ্য রোহিঙ্গা ক্রাইসিস ইজ শেখ হাসিনা’শীর্ষক একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। লেখক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের রেসিডেন্ট ফেলো এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক।
নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘রোহিঙ্গা সংকটে সত্যিকার বীর নারী’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনেক ধনী ও বিশাল দেশের নেতাদের পেছনে ফেলেছেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ধনী দেশ নয়, তবে আমাদের হৃদয়টা বিশাল।’ দুমির ওই নিবন্ধ পরে গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী নিউজউইক, ওয়ার্ল্ড নিউজ নেটওয়ার্কসহ বিভিন্ন পশ্চিমা গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়।
নিবন্ধে দুমি আরো লেখেন, পশ্চিমারা হয়তো ‘দ্য লেডি অব ইয়াংঙ্গন’ এর পরিবর্তে ‘দ্য লেডি অব ঢাকা’কে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নয়, তবে রোহিঙ্গা সংকটে সময় এখন শেখ হাসিনার। পশ্চিমা দুনিয়ায় শেখ হাসিনার চেয়ে সু চি বেশি পরিচিত। কিন্তু তাদের মধ্যে বেশ দারুণ সাদৃশ্য রয়েছে। তারা দুজনেই ১৯৪০ সালের ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ দশকে জন্ম নিয়েছেন। তাদের দুজনেরই বাবা জেনারেল অং সান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ নিজ দেশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খ্যাত। তাদের উভয়কেই হত্যা করেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ।
আরো একটি কাকতালীয় ঘটনা আছে। শেখ হাসিনা এবং সু চি দুজনই জীবনের একটা সময় দিল্লিতে কাটিয়েছেন- ষাটের দশকে শিক্ষার্থী হিসেবে সু চি আর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে হত্যার পর নির্বাসনে থাকার সময় শেখ হাসিনা।
তাদের দুজনের মধ্যে স্বল্পভাষী সু চি পশ্চিমা জগতে বেশি পরিচিত। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জন্য ১৯৯১ সালে নোবেল পুরস্কারজয়ী হওয়ার পর সু চি দৃঢ়তার সঙ্গে বহু বাধা পেরিয়েছেন। তার ইংরেজি বলায় পারদর্শিতা এবং বিশ্বজনীন ভাবমূর্তি এখনো বহাল।
‘বিপরীতে শেখ হাসিনা একটি খ্যাতনামা পরিবারে জন্ম নিলেও কখনো বাংলাদেশের অভিজাতদের কাতারে নাম লেখাননি। গত সপ্তাহে নিউইয়র্কে এক সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর শেখ হাসিনা আমাকে তার বাবার লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ উপহার দেন। আমি বইটিতে তাকে স্বাক্ষর করার অনুরোধ করলে তিনি চমৎকারভাবে বাংলায় তার নাম লেখেন।’
‘শেখ হাসিনা তার দরিদ্র ও জনবহুল দেশটিতে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে যে বিশাল দরদ ও সহমর্মিতা দেখিয়েছেন, তা অনেক বড় ও ধনী দেশের নেতারাও দেখাতে পারেননি। শেখ হাসিনা আমাকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ধনী দেশ নয়, তবে আমাদের হৃদয়টা বিশাল।’
এদিকে শনিবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা ‘খালিজ টাইমস’ রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি মানবিক আবেদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাচ্যের নতুন তারকা হিসেবে অভিহিত করেছে।
খালিজ টাইমসে ‘শেখ হাসিনা নোজ দ্য আর্ট অব কমপ্যাশন’ (শেখ হাসিনা জানেন সহমর্মিতার নৈপুণ্য) শীর্ষক নিবন্ধে কলামিস্ট অ্যালান জ্যাকব বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গার জীবন রক্ষায় সীমান্ত খুলে দিয়ে শেখ হাসিনা তার যে সহমর্মিতা ও সমানুভূতি দেখিয়েছেন, সেজন্য এ সপ্তাহে তার চেয়ে বড় কোনো ‘হিরো’ দেখছি না।
নিবন্ধের শুরুতেই জ্যাকব শেখ হাসিনাকে নিয়ে এর আগে না লেখার জন্য অনুতাপ প্রকাশ করেন এবং সু চির চোখ দিয়ে রোহিঙ্গা সংকটকে দেখার জন্য বিশ্ব গণমাধ্যমকে অপরাধী হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি লিখেছেন, লেখার বিষয় নির্বাচনের আগে সব সময়ে আমাকে কোনো বিষয় এবং ব্যক্তিবর্গের ব্যাপারে ভাবতে হয়, এখানে স্বীকার করতেই হয় যে এ সপ্তাহে আমার লেখার বিষয় দক্ষিণ ভারতের একজন অভিনেতা এবং রাজনৈতিক মাঠে তার আশাবাদী কর্মকাণ্ড নিয়ে লেখার বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু আমি যখন বুঝতে পারলাম, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হচ্ছেন প্রাচ্যের নতুন তারকা, তখন আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম।
জ্যাকব বলেন, হ্যাঁ, মিয়ানমারে একজন নোবেল বিজয়ীর উজ্জ্বলতা হারানোর বিষয় নিয়ে মিডিয়া অধিক ব্যস্ত থাকায় আমরা এই মহৎ সুযোগটি হারিয়েছি। গত সপ্তাহে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক আবেদনটি অবজ্ঞা করায় একটি অপরাধের বোঝা আমাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলেছেন, ‘এটি (রোহিঙ্গাদের নির্যাতন) তার হৃদয় ভেঙে দিয়েছে।’
জ্যাকব বলেন, সু চি ও শেখ হাসিনা তাদের নিজ নিজ দেশের মুক্তিসংগ্রামের মহানায়কের কন্যা। দুজনই খুব কাছ থেকে ট্র্যাজেডি দেখেছেন। যদিও ফারাকটা বিশাল। মানবতা যখন বিপন্ন, তখন একজন নিছক দর্শক হয়ে থাকার পথ বেছে নিলেন, অপরজন দেখালেন অমায়িক দয়া। শেখ হাসিনার প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ছোট্ট দেশটিতে একবারে ৪ লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছেন।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘে অধিবেশন চলাকালে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে তিন লাখ শরণার্থী পেয়েছি, কিন্তু আমাদের স্থান সংকুলানের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আরো বেশি শরণার্থী গ্রহণের বিশাল হৃদয় আমাদের রয়েছে।’
জ্যাকব আরো লিখেছেন, বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীর মতো নেতারা যখন কর্ণধার হন, তখন অভিবাসন সমস্যা নিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত বিশ্বে আশার আলো জ্বলে উঠে। তার কর্মকাণ্ড প্রথমে ক্ষীণ মনে হয়েছিল, তবে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গা সমস্যা প্রত্যক্ষ করতে খালিজ টাইমস যখন একজন রিপোর্টার পাঠাল, তখনই প্রকৃত সমস্যাটি সামনে চলে আসে। রিপোর্টারের বর্ণনায় উঠে এসেছে, দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্র। ক্ষুধার্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা খাদ্যের জন্য অপেক্ষা করছে, জীর্ণ কুটিরে বসবাস করছে। এ ঘটনা আমাদের ব্যথিত করেছে।
তিনি বলেন, বিশ্ব গণমাধ্যম রোহিঙ্গা সংকটকে সু চির চোখে দেখার জন্য অপরাধী। দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দ্বারা দেশছাড়া হওয়া রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে সু চিকে অসহায় মনে হয়েছে। অনেকেই অনুধাবন করতে পারেনি যে দুই বছর আগে তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি নির্বাচনে বিজয়ী হলেও এখন পর্যন্ত দেশটির সামরিক জান্তাই মূল ক্ষমতায় রয়েছে।
সু চি তার দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে দেশ থেকে বিতাড়ন রোধের পরিবর্তে যা করছেন, তা হচ্ছে তিনি নির্বাচনে সাফল্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন কিংবা বলা যায় তিনি ব্যালটের ফায়দা লুটছেন। সু চি এত দিন ধরে যে রাজনৈতিক সংগ্রামটি চালিয়ে এসেছেন, তা সামাজিক ও মানবিক অঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় তা থেকে তিনি বিচ্যুত হয়েছেন। তার সামরিক বাহিনী যখন রোহিঙ্গা নিধনে মেতে আছে, তখন তিনি ফার্স্ট কাউন্সেলর হিসেবে ক্ষমতার জাঁকজমক ও সুযোগ-সুবিধায় আটকা পড়ে আছেন এবং এর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন।
জ্যাকব বলেন, ‘যখন তার সবচেয়ে বেশি উচ্চকণ্ঠ হওয়ার দরকার ছিল, তখন তিনি সোচ্চার হতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই তথাকথিত এই আইকনের জন্য আমার সহমর্মিতা নেই বললেই চলে। গণতন্ত্র যখন পছন্দসই সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে যায়, তখন এটি ত্রুটিপূর্ণ ও বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। আর জান্তা ও একনায়কদের সঙ্গে সন্ধি করা সহজ হয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের নিয়ে সু চির সুচিন্তিত নীরবতা অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।