বাদশা মিয়া, কাজটাও করতে গিয়েছিলেন বাদশাহী। মনের মাঝে পুষে রাখা দিনবদলের স্বপ্ন সফলে পাড়ি জমান সাগরে।
কিন্তু হলো কই, ব্যর্থরথে এখন ঝরাচ্ছেন স্বজনদের চোখের পানি। কাঁদতে কাঁদতে বাদশার মা নূরজাহানের চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে।
তার মত এমন হাজারো মা এখন কাঁদছেন সন্তানের পথ চেয়ে। তাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে বাতাস।
কক্সবাজারের এক টেকনাফেই নিখোঁজ রয়েছেন সহস্রাধিক বাংলাদেশি। ধারণা করা হচ্ছে, এরা সবাই অবৈধ পথে সাগর পাড়ি দিয়ে অভিবাসী হতে চেয়েছিলেন।
বাদশা মিয়া, বয়স আর কতই বা, ২৪। বাড়ি সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের উলুচামরী গ্রামে। দিনমজুরের কাজ করতেন। দিনে আয় হতো ৩০০ টাকা। কিন্তু বাদশার কি আর ওসব করে চলে। শুরু করলেন স্বপ্ন দেখা, দিন বদলে ফেরাবেন সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য।
যে চিন্তা সেই কাজ। ভালো চাকুরি, মোটা অংকের বেতন, উন্নত জীবনের স্বপ্ন যুবক বাদশা মিয়াকে ফেলে দিলো মালয়েশিয়া পাচারকারী দালাল চক্রের প্রলোভনের ফাঁদে। তিনি দালাল ধরে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাত্রা স্বপ্নকে বাস্তবেই রূপ দিলেন।
বাদশা মিয়া ছিলেন ঘরের একমাত্র উপার্জনকারী। বৃদ্ধা মা নূরজাহান তাই চাইছিলেন না বাদশা মালয়েশিয়ায় যাক। কিন্তু মায়ের বাধা উপেক্ষা করে বাদশা রওনা হলেন অথৈ সমুদ্রে।
সেই যে ২২ মাস আগে বাদশা গেলেন, কোথায় গেলেন, বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন তাও জানতে পারছেন না মা নূরজাহান। অথচ ছেলে মাকেই স্বপ্ন দেখিয়েছিল, স্বপ্নের মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দিনে ৪-৫ হাজার টাকা আয় করবেন। তাও আবার মাত্রই ৭০,০০০ টাকা দিলেই পৌঁছা যাবে মালয়েশিয়ায়।
ছেলের সেই স্বপ্ন বৃদ্ধা মায়ের কাছে এখন যেন দুঃস্বপ্ন হয়েই ফিরে ফিরে আসছে। শুধুই কি বাদশা মিয়া! না, তার মতো একই স্বপ্নে বিভোর হয়ে দুঃস্বপ্নের পথে পা বাড়িয়েছেন একই এলাকার বাবুল, আবুল কালামসহ টেকনাফ অঞ্চলের নানা বয়সী হাজারো মানুষ।
স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ‘নিখোঁজ’ হয়ে আছেন ৫০০’র অধিক মানুষ। ধারণা করা হচ্ছে, এ সকল লোক ভাগ্য বদলাতে গিয়ে হারিয়ে গেছেন থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ার জঙ্গলের মতো কোথাও। হয়তোবা গভীর সাগরেই হয়েছে তাদের সলিল সমাধি।
টেকনাফ উপজেলায় ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মালয়েশিয়া যাত্রা করে খোঁজ মিলছে না ৫০০’র অধিক মানুষের। তারা আদৌ ফিরবেন কিনা তাও জানে না তাদের পরিবার।
থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার গভীর জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ এই যুবকদের পরিবার ও উপজেলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে উৎকণ্ঠা। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডগামী হাজার মানুষের পরিবারে এখন সীমাহীন হতাশা। স্বজনদের বিলাপে ভারি হয়ে উঠেছে পরিবেশ।
জানা গেছে, দুই বছরের বেশি সময় আগে স্বপ্নপূরণে বাড়ি ও পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের জাহালিয়া পাড়ার হাজি সব্বির আহমদের ছেলে অলী আহমদ (৪৪), মোজাহের মিয়ার ছেলে শাকের আহমদ (২৫), হাজি আবুল হোসেনের ছেলে আবুল কালাম (২২), ছলিমা খাতুনের স্বামী মো. আবাদুল্লাহ (২৫), আবুল হেসেনের ছেলে মোহাম্মদ শফিক উল্লাহ (৩০) ও সলিম উল্লাহ (৪৬), ফরিদ আলমের ছেলে আব্দুর রকিম (৩১), নুরুল ইসলামের ছেলে জাফর আলম (২৫), হাতিয়ারঘোনা করাচিপাড়ার সুলতান মিস্ত্রির ৩ ছেলে মো. ইসমাঈল (৩০), মো. তৈয়ব (২৮) ও মো. ছিদ্দিক (৪০), হাতিয়ার ঘোনার বশির আহমদের ছেলে আলী আহমদ (৩৩), তজিল আহমদের ছেলে মোহাম্মদ শফিক (২০), মৃত সৈয়দ আহমদের ছেলে মো. আমিন (২২), মো. আলীর ছেলে আব্দুস শুক্কুর (৩০), রশিদ আহমদের ছেলে মো. ইব্রাহিম (২২), লেংগুরবিল এলাকার ফজল আহমদের ছেলে মো. হেলাল (১৮), কবির আহমদের ছেলে মো. আমিন (৩৪), মৌলানা জহির আহমদের ছেলে মো. ইউনুছ (৩০), আহমদ হোসেনের ছেলে মো. তৈয়ব (৩০), মো. শফি উল্লাহর ছেলে মহিবুল্লাহ (২৫) ও হ্নীলা ইউনিয়নের উলুচামরী এলাকার শওকত আলীর ছেলে সাদ্দাম হোসন।
আরো গেছেন হ্নীলা ইউনিয়নের ওয়াব্রাং এলাকার ফরিদ আলমের ছেলে মো. বাবুল, নুরুল আলমের ছেলে আবছার, লেদা এলাকার আহমদের ছেলে এরশাদ উল্লাহ, একই এলাকার রশিদ আহমদ, টেকনাফ বাহারছড়া ইউনিয়নের উত্তর শিলখালী গ্রামের নুরুল বশর বলীর ছেলে জাহেদুল আমিন ও একই গ্রামের বদিউল আলমের ছেলে জয়নাল উদ্দিন, হ্নীলা ইউনিয়নের ওয়াব্রাং এলাকার সুলিস পাড়ার আবু সিদ্দিকের ছেলে মোহাম্মদ হোসেন (২৫) ও মোহাম্মদ সেলিম (২১), হ্নীলা ইউনিয়নের পশ্চিম সিকদার পাড়া এলাকার আবু সিদ্দিকের ছেলে মোহাম্মদ ইউছুপসহ উপজেলার আরো সহস্রাধিক মানুষ।
এদের মধ্যে মোহাম্মদ ইউছুপ ২২ মাস আগে সেই বাদশা মিয়ার সঙ্গেই স্বপ্নের মালয়েশিয়ায় যাত্রা করেছিলেন। তারও আজ পর্যন্ত কোনো খোঁজ নেই।
উপরের সবাই সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাত্রার পর আর দেশে ফিরে আসেননি। তাদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের কোনো যোগাযোগও নেই। নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরাই এসব তথ্য দিয়েছেন।
এসব নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যদের শুধুই উৎকণ্ঠা- এই মালয়েশিয়াগামীরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কিংবা আদৌ বেঁচে আছেন কিনা।
স্বজনেরা আশায় বুক বেঁধে আছেন, তাদের ছেলে, তাদের বাবা, তাদের স্বামী আবার নিজের বাড়িতে ফিরে আসবেন। শুধু বাদশা মিয়ার মা নূরজাহান নন, টেকনাফে কাঁদছেন হারিয়ে যাওয়া সহস্রাধিক সন্তানের মা।
টেকনাফের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও একাধিক সূত্রের দাবি, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া যাত্রা নতুন কোনো ঘটনা নয়। গত তিন বছর ধরে চলে আসছে এসব পাচারের গল্প। এই সময়ে সাগরে ট্রলারডুবিতে পাঁচ শতাধিক মালয়েশিয়াগামী বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন ২০০০’র বেশি।
পাচারকারীদের গুলিতেও নিহত হয়েছেন অনেকেই। যাত্রা পথে উদ্ধার হয়েছেন ২,৯৪৫ জন। আর একই সময়ে মানব পাচার আইনে মামলা হয়েছে ৩০৬টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১,৫৩১ জনকে। এদের মধ্যে আটক হয়েছেন ৪৭৭ জন। ক্রসফায়ারে মারা গেছেন ৬ জন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, টেকনাফ উপকূলের নানা বয়সী ৫০০০’র মানুষের কোনো খোঁজ নেই। এদের অনেককেই অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মালয়েশিয়ায় পাচারের উদ্দেশ্যে। সেখানে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়ই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
তবে শেষ পর্যন্ত তাদের আর মালয়েশিয়ায় পৌঁছানো হয় না। হয় দালালদের নির্যাতনে মাঝদরিয়াতেই মারা পড়েন, নয়তো ঠাঁই হয় থাইল্যান্ডের গহীন জঙ্গলে।
পাচারকারীরা মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার বদলে তাদের সেখানে বন্দি করে রাখে। পরে তাদের হত্যার হুমকি দিয়ে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ। তবে টাকা দিলেও অনেক সময় মুক্তি মেলে না। তাদের হত্যা করে কবর দেয়া হয় গহীন বনেই।
আর থাইল্যান্ডের গহীন বনে একের পর এক গণকবরের সন্ধান পাওয়ায় কক্সবাজার উপকূলের নিখোঁজ এই ৫০০ পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
পাচার হয়ে মালয়েশিয়ার বন্দি শিবির থেকে ফিরে আসা হ্নীলা ইউনিয়নের ফুলের ডেইল এলাকার আলী জুহারের ছেলে শাহজালাল দালালদের নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি নিজের চোখেই নির্যাতনের অবর্ণনীয় দৃশ্য দেখে এসেছি। আমার সামনেই বন্দি শিবিরে মুক্তিপণের টাকা দিতে না পারায় নির্যাতন করে মেরে কবরে ফেলে দেয়া হয়েছে অনেককে।’
শাহজালাল বলেন, ‘ট্রলারে যাত্রাপথে অসুস্থ হলে তাকে ধাক্কা মেরে সাগরে ফেলে দেয়া হয়। যাওয়ার পথে ট্রলারে অসুস্থ হয়ে আমার হাতের উপরেই মারা গেছেন তিনজন বাংলাদেশি।’
দালালদের বন্দি ক্যাম্পে নির্যাতনের বর্ণনা দেয়া মুখে সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের বিভিন্নস্থান থেকে দালালরা লোকজন সংগ্রহ করে ট্রলারে করে মালয়েশিয়ার কথা বলে নিয়ে যায় থাইল্যান্ড উপকূলে। সেখানে নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করা হয় জনপ্রতি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। তারপর মুক্তিপণ আদায়ে চলে নির্মম ও অমানবিক নির্যাতন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘কক্সবাজারে আগে থেকেই মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। থাইল্যান্ডের ঘটনার পর যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।’
তিনি জানান, গত ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৯৭টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ১৯০ জনকে। তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬৩ জনকে। অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় উদ্ধার করা হয়েছে ২৩৫ জনকে।
পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, গত ৩ মে থেকে ৯ মে পর্যন্ত এই সাত দিনে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৬ জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।